চাদরেও ঠাণ্ডা মানাচ্ছে না। ঠকালো? অথচ বলল, আসল কাশ্মীরি শাল নাকি। আমার এই প্রথম এইদিকে আসা। ছাপরা স্টেশান থেকে বারো কিলোমিটার দূরে একটা জঙ্গল ঘেরা স্টেশান। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। আমার ট্রেন কাল সকাল ছ'টায়। স্টেশানে কেউ নেই, টিকিট কাউন্টার বন্ধ। ওয়েটিং রুম বলতে একটা হতকুচ্ছিত নোংরা ঘর। কিন্তু এই ঠাণ্ডায় এখানে আস্তানা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে চাদরটা গায়ে দিয়ে চুপ করে বসে আছি একটা সিমেণ্টের বেঞ্চে। আমার কাজ এই গ্রামগুলোর শৌচালয়ের অবস্থা দেখে সরকারকে রিপোর্ট করা। অনেকেই কাজটা বাড়ি বসে জল মিশিয়েও করে, আমার কোনো পিছুটান নেই, তার উপর বেড়াতেও ভালো লাগে সেই টানে বেরিয়ে পড়ি। সবই ঠিক ছিল, হঠাৎ করে আজকের সন্ধ্যের ট্রেনটা ক্যান্সেল হয়েই যা উৎপাত হল। কোন এক রাজনৈতিক নেতা খুন হয়েছে, সেই জন্য সব বন্ধ।
খিদে পাচ্ছে, একটা বিস্কুটের প্যাকেট আছে, কিন্তু এখনই খুলতে ইচ্ছা করছে না, আরেকটু রাত হোক, খিদেটা আরেকটু বাড়ুক, রাতে তো এটাই সম্বল। একটু ঝিমুনি এসেছে, হঠাৎ 'ঠং' করে একটা আওয়াজ হতে তাকিয়ে দেখি একটা নেড়ি কুকুর এসে গুটিয়ে শুলো। কোনো ফেলে রাখা টিনের পাত্রের সাথে ওর গায়ের ধাক্কা লেগেছে হয়ত। মোমবাতিটা বড়জোর আর আধঘন্টা জ্বলবে। আবার চোখ বন্ধ করে শুলাম।
"বাবু... ওই বাবু..."
একটা লাল পাগড়ি বাঁধা মাথা। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা মাঝবয়েসি একটা লোক। আমার দিকে তাকিয়ে উৎসুক চোখে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, "কি চাই?" একটু একটু ভয় লাগল, চোর ডাকাত না তো? মাওবাদী?
লোকটা বলল, "আরে আমিও ভোরের ট্রেন ধরব, আমি বাঙালি, ছাপরায় থাকি। আপনি তো ওই পায়কানার ঘর দেখতে এসেছিলেন?"
আমি বললাম, "হ্যাঁ।"
"কিছু খাওয়া তো হয়নি বোধহয়?"
আমি বললাম, "ওই..."
"আমার সাথে রুটি তরকারি আছে, আসুন খেয়ে নিই, বাইরেটায় আসুন, এটা খাওয়ার মত জায়গা নয়।"
একবার ভাবলাম বলি থাক, কিন্তু ক্লান্তিতে হোক, কি হঠাৎ একটা মানুষকে দেখার আনন্দে হোক, কিছু না বলে লোকটার পিছনে গেলাম।
বাইরে একটা গাছের তলায় বসলাম। পূর্ণিমা। মাথার উপরে বিরাট চাঁদ। নিম গাছটার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে, দুটো রুটি পেটে পড়তেই আমার কবিত্ববোধ ফিরে এলো। লোকটার নাম আদিত্য পাল, বর্ধমানে আদি বাড়ি, ছাপরায় মিষ্টির দোকান।
খাওয়ার পর একটা বিড়ি এগিয়ে দিল। নিলাম। নিজে জ্বালিয়ে আমারটা ধরিয়ে দিল। আমরা চুপচাপ বসে। হঠাৎ একটা ডাক শুনলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, "কিসের ডাক এটা?"
আদিত্য আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বনমোরগ, সচরাচর এরকম ডাকে না, তবে এটা আসলে বনমোরগ নয়, তাই এরকম ডাক। থাক সে কথা শুনে আপনার কাজ নেই, এক বিশ্বাস করবেন না, তার উপর ভয় পেয়ে গেলে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে বিপদে পড়বেন জ্বরটর হয়ে।
ভয় যে লাগেনি তা না। ওনার বলার মধ্যে এমন একটা সুর ছিল গা-টা একটু ছমছম করেই উঠল। তবু পৌরুষে লাগল, শহুরে পৌরুষ, বললাম, আরে আমি ভয় পাই না, আপনি বলুন।
আদিত্য একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে বলতে শুরু করল,
"সে অনেকদিন আগের কথা। তখন এখানে একটা আশ্রম ছিল। আসলে আশ্রম না। তখন ইংরাজ আমলে অনেকে ঝোঁকের মাথায় বিপ্লবীদের দলে নাম লিখিয়ে খুন-খারাবির কেসে ফেঁসে যেত। তারপর সাধু-টাধু হয়ে ছদ্মবেশে জীবন কাটাতো লুকিয়ে। নইলে তো ফাঁসি নাতো নির্বাসন, জানেনই তো। তা এখানে এক বাঙালি ঢঙ্গী সাধু ছিল। স্বাস্থ্য ভালো, কথা নাকি দারুণ বলতে পারত, কিছু যাদুটোনাও শিখে নিয়েছিল। তা তার ব্যবসা ছিল মেয়েমানুষের। কোনো এক তান্ত্রিকের পাল্লায় পড়ে মেয়েদের নিয়ে নোংরামি করে মেরে পুঁতে দিত। ততদিনে ওর অনেক সাগরেদও জুটে গিয়েছিল। তারা কেউই সুস্থ সামাজিক জীবনের মানুষ ছিল না। তো আশ্রমটা ধীরে ধীরে মধুচক্র হতে শুরু করেছিল। তারপর যা হয়, কিছু একটা অশান্তিতে সে ভণ্ড সাধু খুন হল। সব টাকা নিয়ে পালালো তার কাছের শিষ্য বহ্নিমান। তাকেও অবশ্য কয়েকদিন বাদে ওই রেললাইনের ধারে মাথা কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। মাথাটা আজ অবধি কেউ পায়নি।"
আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যে আদিত্য আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে না, নইলে আমার মুখের চেহারা আর যা হোক পৌরুষের গর্ব করার জায়গায় অন্তত নেই। আদিত্য বলেই যাচ্ছে।
"সেই থেকে এই পূর্ণিমার দিনগুলোতে ওই ভণ্ড সাধু বনমুরগীর রূপ ধরে সব মৃত মেয়েগুলোর সাথে সারা জঙ্গল ঘুরে বেড়ায়। কাউকে কিচ্ছু বলে না, কারোর ক্ষতিও করে না, যদি না সে বাধা দিতে চায় বা নোংরামি করতে চায় কিছু। আপনার ভাগ্য ভালো থাকলে আপনিও দেখতে পারবেন।"
আমি আঁতকে উঠলাম, "মানে?"
আদিত্য হঠাৎ ইশারা করে বলল, "চুপ!"
সামনের দু'জোড়া রেললাইনে চোখ আটকে আদিত্যর, আমিও সেদিকে তাকালাম, জ্যোৎস্নায় চকচক করছে লাইনদুটো। আচমকা একটা গোল মতন কি লাইনের ধার ঘেঁষে ফুলে উঠতে লাগল, ক্রমে একটা মানুষের মাথার মতন আকার নিয়ে আমাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো, আমি নিজের মধ্যে নেই, হঠাৎ আমার পাশ থেকে "তবে রে শালা, পালাবি ভেবেছিস আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে" বলে, আদিত্য ঝাঁপ দিয়ে ওই মাথাটার উপর পড়ল। একটা আর্ত চীৎকারে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে ভেঙে পড়ল। ক্রমে চোখের সামনেই দেখলাম আদিত্য আর ওই মাথাটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আমার পাশে আদিত্যর ধুতি, পাঞ্জাবি, পাগড়ি পড়ে রইল। আমার নড়বার শক্তি নেই শরীরে আর। মনে হচ্ছে যেন আমার চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে।
আমার জ্ঞান ফিরল ছাপরার হাস্পাতালে পরের দিন দুপুরেই। ধুম জ্বর। পরের গল্পটা শুনলাম হাস্পাতালের ডাক্তারের কাছে।
ওই বহ্নিমানের পিছনে লাগানো হয়েছিল দুঁদে পুলিশ অফিসার আদিত্য পালকে। সে নিখোঁজ তারপর থেকেই নাকি। বডিও পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রত্যেক পূর্ণিমাতে ওই স্টেশানে ওরা দু'জন ওরকম করে থাকে। এর আগেও অনেকে দেখেছে। তবে সেই বনমোরগ বাবাকে দেখতে হয়নি সে নাকি অনেক ভাগ্যের। ওনাকে দেখলে নাকি অনেকেই ফিরতে চায় না, এমন একটা সম্মোহিনী শক্তি জানা আছে নাকি ওনার।