Skip to main content


রাত ক'টা হবে? একটা দেড়টা হবে। প্রশান্ত'র ঘুম ভেঙে গেল। আবার সেই শব্দটা না?
এটা নিয়ে পরপর দুটো রাত। ঠিক এই সময়টায় প্রশান্ত'র ঘুম ভেঙে যাচ্ছে একটা শব্দে। ঝাড়খণ্ডের একটা মফস্বল অঞ্চল। এখানে প্রশান্ত'র মাসীর বাড়ি। সে এই বছর এম.এ. পরীক্ষা দিল। মাসীর বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। কিন্তু মুশকিল হল, সে আসার দু'দিন পরেই মাসীর জা খুব অসুস্থ হয়ে ধানবাদ হাসপাতালে ভর্তি, মাসী সেখানে গেছেন। মাসী বিধবা। নিঃসন্তান।
প্রশান্ত'র বাড়ি বোকারোতে। সে আর ফিরে গেল না।এখানে রান্নার দিদি আছে। তাছাড়া সে প্রায়ই আসে বলে এ পাড়ার অনেকের সাথে তার বেশ ভালোই পরিচয় আছে। বেশ ক'দিন বিশ্রাম নেওয়া যাবে। পরীক্ষার জন্য যা ধকল গেল।
সে বিছানা ছেড়ে উঠল। দোতলা বাড়ি। উপরতলা থেকে আওয়াজটা আসছে মনে হল। গত দু'দিনও হয়েছিল। তার ওঠার ইচ্ছা হয়নি। বেড়াল ইঁদুর ভেবেছিল। আজ কিরকম একটা সন্দেহ হচ্ছে। এ তো বিড়াল ইঁদুর না। মোবাইলে দেখল রাত পৌনে দুটো। টয়লেটে গেল। ফ্ল্যাশ করে বাইরে এসে টয়লেটের দরজার ছিটকিনিটা আটকাতে যাবে, অমনি আবার আওয়াজটা হল। খড়খড় খড়খড়। দোতলা থেকেই আসছে।
প্রশান্ত দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। গা একটু ছমছম করছে। কিন্তু সে তো ভীতু না। বহুবার বন্ধুদের সাথে শ্মশানে রাত কাটিয়েছে। খুব সোস্যাল সে বরাবরই।
আওয়াজটা আবার হল। সে দোতলায় উঠতে শুরু করল। মাসীর শোয়ার ঘর থেকে আওয়াজটা আসছে মনে হল। চারদিক নিঃশব্দ। দূরে পাড়ার একটা কুকুর ডাকছে। দোতলায় একটা টানা বারান্দা আর পরপর তিনটে ঘর। শেষেরটা ঠাকুরঘর।
দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। কোনো আওয়াজ নেই। মাসী না থাকলে সে এই ঘরটায় আসে না। তার কেমন একটা অস্বস্তি হয়। আওয়াজটা হচ্ছে না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজটা পাচ্ছে। আর বুকটার কাছে একটা যেন চাপ ধরে আছে।
নাঃ শব্দটা হচ্ছে না আর। তবে ইঁদুরই হবে। কাল একটা ইঁদুর মারার বিষ কিনে আনলে হবে শাহুজীর দোকান থেকে। সামনেই দোকান। এই ভেবে সে ফিরতে যাবে, আচমকা মনে হল দরজার ওপাশে কেউ যেন হেঁটে গেল। একটা পায়ের শব্দ পেল। তার সারা শরীর দিয়ে একটা হিম বয়ে গেল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দম আটকে আসছে। তবু দাঁড়িয়ে আছে সে, পা সরছে না। কপালের কাছটা ঘামছে বুঝতে পারছে। বাইরে কুকুরটা চুপ।
হঠাৎ মনে হল তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে। চট্ করে ঘুরে তাকাল, নাহ্, কেউ না তো! আচমকা টাওয়েলটা ঝুপ্ করে বারান্দায় ঝোলানো দড়ি থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। সাথে সাথেই মনে হল দরজাটা যেন একটু নড়ে উঠল। সে ফিরে দরজাটার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে ঢুকবে কি নীচে নেমে যাবে, এমন সময় মনে হল মাসীর ঘরের খাটে কেউ বসল। একটা ক্যাঁচ করে আওয়াজ হল।
প্রশান্ত'র মাথাটা এবার কেমন জ্যাম হতে শুরু করেছে। সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে যেন। বেশ বুঝতে পারছে সে ছাড়াও ঘরে কেউ একজন আছে, কে?


-----
ঘরে ঢুকল। ঢুকেই চমকে উঠল। মাসীর খাটে একজন বসে। সে তাড়াতাড়ি দরজার বাঁ দিকে স্যুইচবোর্ডের দিকে হাত বাড়ালো। আলো জ্বালতেই অবাক। কেউ কোত্থাও নেই। শুধু মেঝেতে একটা লুডোর বোর্ড পাতা। সাপলুডোর পাতাটা খোলা। ঘুটিটা একটা মইয়ের উপরের ঘরে। দান চালার কৌটোটা মেঝেতে উপুড় করা। আর ছক্কাটা তার পাশে পড়ে।
কিছুই মাথামুন্ডু বুঝতে পারছে না সে। এতটা ভুল হল কি করে? মাসী যাওয়ার আগে এগুলো তুলে যায়নি? তবে কি সত্যিই ইঁদুরের চলাফেরায় এগুলোর সাথে ধাক্কা লেগে ওরকম আওয়াজ হচ্ছিল? কিন্তু আওয়াজটা যেন সে বুঝতে পারছে এবার, সে তো চাল দেওয়ার আগে কৌটোতে ছক্কা নাড়ার শব্দ!
নাঃ মনের ভুল যত। সে এই বলে উঠতে যাবে, হঠাৎ বাথরুমের দরজাটা ধুম করে বন্ধ হয়ে আবার খুলে গেল। প্রশান্ত'র গলার কাছটা শুকিয়ে আসতে শুরু করেছে। সে ঘামছে এবার। কোনোরকমে জিজ্ঞাসা করল? কে ওখানে?
কোনো উত্তর নেই। তার উঠে দাঁড়াবার শক্তিও যেন নেই। তবু জোর করে উঠে দাঁড়ালো। বাথরুমের দরজাটার দিকে পায়ে পায়ে এগোতে শুরু করল। নিজের বুকের আওয়াজ নিজেই শুনতে পাচ্ছে এখন। বাথরুমে কেউ নেই। দরজাটা বন্ধ করে যেই ঘুরেছে অমনি দক্ষিণদিকের জানলা হড়াস করে খুলে গেল। পর্দাটাও সাথে সাথে নীচে পড়ল। ঘর কাঁপিয়ে আওয়াজ হল ঠড়াং করে। তার সারাটা শরীর কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, কে আপনি?
বলতেই, লুডোটা সরে মেঝের একপাশে চলে গেল আচমকাই। ঘরের আলোটা ঝুপ করে নিভে গেল। রাস্তার আলো জানলা দিয়ে ঠিক লুডোর উপরটায় এসে পড়েছে। কৌটোটা হঠাৎ করে শূন্যে উঠে গেল। খড়খড় করে নড়ছে।
সে মন্ত্রচালিতের মত পায়ে পায়ে লুডোর দিকে এগোতে লাগল। সামনে ওটা কি? একটা লম্বা ছায়ামূর্তি বসে। অন্ধকারে আরো অন্ধকারের মত। কে যেন তাকে জোর করে বসিয়ে দিল সামনে। তার দিকে চালার কৌটোটা এসে পড়ল। ছায়ামূর্তিটা যেন তার দিকে তাকিয়ে। আচমকাই তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে মোবাইলটা তার সামনে এসে পড়ল, তাতে মাসীর নাম্বারটা ডায়াল হচ্ছে নিজে থেকেই।

ফোনটা কানে নিল। কিছুক্ষণ পরেই মাসী ধরল।
- হ্যাঁ রে বল।
তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না
- মাসী?
- তোর গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন?
- মাসী, তোমার ঘরে লুডো...
- বুঝেছি-
একটা নিস্তব্ধতা ওদিক থেকে কিছুক্ষণ।
- তুই ভয় পাস না। আজ অমাবস্যা। তোর মেসো। প্রত্যেক অমাবস্যার তিনদিন আগে থেকে এ বাড়িতে আমার সাথে লুডো খেলতে আসে। ভয় করিস না। ও তোর কোনো ক্ষতি করবে না।
( প্রশান্তর মেসো বছর তিনেক আগে রেলে কাটা পড়ে মারা গিয়েছিলেন।)