সৌরভ ভট্টাচার্য
19 April 2018
কুয়াশার মধ্যে কিছুক্ষণ হাত রাখলে হাত ভিজে যায়। সেই ভিজে হাতে যদি আঁকিবুঁকি কাটা যায়, সে কি কুয়াশার প্রতিচ্ছবি হয়? কুয়াশার কোনো আকার হয় না। কুয়াশার একটা প্রবল অস্তিত্ব হয়। ভালোবাসা একটা কুয়াশার মত। সে গিয়ে গিয়ে ফিরে আসে। যে নিঃসঙ্কোচে দাঁড়ায় তাকে ভিজিয়ে যায়। তার চারদিকে ঘন হয়ে আসে। তাকে আগে-পিছে চারপাশে কিচ্ছু দেখতে দেয় না। নিজেকেও না। সময়কেও না। শুধুই কুয়াশা। কুয়াশার মত ভালোবাসা।
মার্কেজ এরকম একটা গল্প শুনিয়েছেন। একজন নারী। যে তার বালিকা বয়সে এক পুরুষের ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছিল। ভেসে গিয়েছিল। দুই হাতে কুয়াশা নিয়ে খেলেছিল। হঠাৎ সূর্য ওঠে। প্রবল তাপে কুয়াশা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়। সে বালিকাকে পাঠানো হয় নির্বাসনে। পুরুষটি হয়ে পড়ে দিশেহারা। তবু যোগাযোগ থাকে। টেলিগ্রামে।
বালিকা কিশোরী হয়ে ফিরে আসে। তার মনের মধ্যে সে বালকের প্রত্যাশা। সে এখন যুবক। কিন্তু বাস্তবে তাকে যখন সে কিশোরী দেখে তৎক্ষণাৎ তার মন থেকে একটা গভীর বিতৃষ্ণা জেগে ওঠে - সে বলে, না!
কিশোরী প্রথম যৌবনে পা রাখে। বিয়ে করে এক খ্যাতনামা, উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় চিকিৎসককে। শুরু হয় নতুন জীবন। এই নতুন জীবনের মোহের ঘোর কাটতে তার বেশি বছর লাগে না। তার অন্তঃজীবন বিভক্ত হয় দুই পুরুষে - তার প্রেমিক আর তার স্বামী। তার স্বামীর হৃদয় চলে মস্তিষ্কের, ধর্ম-বিশ্বাস-রাজনৈতিক বিশ্বাসের শাসনে। অন্যদিকে তার প্রেমিকের হৃদয় হয় চালক, মস্তিষ্ক ক্ষুব্ধ আজ্ঞাকারী মাত্র। তবু সে নারী কখনও তাচ্ছিল্যে, কখনও কঠোর উদাসীনতায়, কখনও উপহাসে তার প্রেমিককে দূরেই ঠেকিয়ে রাখে।
তার প্রেমিক পুরুষটির জীবন নানা চড়াই উতরাই দিয়ে বয়ে চলে। শত শত অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এক এক করে। সব সম্পর্কের মূল সুর যৌনতা। তাদের বেশির ভাগই বিধবা, নইলে স্বামী পরিত্যক্তা। তার মধ্যে এক বালিকাও আসে শেষে। কখনও কখনও সে ভুলতে চেষ্টা করে তার প্রাক্তন ব্যর্থ প্রেমকে, কিন্তু পারে না। অসফল হয়। সম্পর্কগুলো শরীরের বাইরে আর এগোয় না।
অবশেষে বিরাশি বছর বয়সে সে নারীর স্বামী মারা যায় যার নিজের বয়েস তখন বাহাত্তর। প্রাক্তন প্রেমিক আবার ফিরে আসার আর্জি জানায় তার জীবনে। তখন সে রীতিমত বর্ষীয়সী ঠাকুমা ও দিদিমা। বেশ কিছু টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে সে তার প্রেমিককে স্বীকার করে একটা দীর্ঘকালব্যাপী সমুদ্রে চলমান জাহাজের মধ্যে। যখন তার প্রেমিক বয়সের ভারে শারীরিকভাবে অক্ষম। তবু বুকে হাত রেখে দেখে যৌবনের একটা ছুটন্ত হৃৎপিণ্ড।
এই তো গল্প। কিন্তু এ শুধু পরিধি। একজন নারী ও পুরুষের সম্পর্কের নানা অনুভূতি, আবেগ কি নিখুঁত, সুক্ষ্ম বর্ণনায় মোহিত করেছে বারবার তা বলার নয়। কোথাও বর্ণনায় আবেগের ঘনঘটায় কোনো চরিত্র তার স্বচ্ছতা হারাচ্ছে না, কেউ ভারসাম্য হারাচ্ছে না। একটা নিরুত্তাপ, নিঃস্পৃহ অন্তর্দৃষ্টি পাঠকের বোধশক্তিকে বারবার এমন কিছু সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাবে, যে বিস্ময়ের সাথে সাথে একটা আত্মসমীক্ষাও যেন শুরু হয়ে যায় পাঠকের অজান্তেই। এক একটা বাক্যকে কতবার পড়েছি তা-ও বলার নয়। আমি জানি না বইটার বাংলা অনুবাদ হয়েছে কি না, কিন্তু ইংরাজি অনুবাদটি চমৎকার।
শেষ কয়েক'টা লাইন বড় অদ্ভুত। জাহাজটি কিছু কারণে তীরে ভিড়তে পারছে না। ক্যাপ্টেন যখন জিজ্ঞাসা করছে, কতবার এই আসা-যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে?
সে প্রেমিক যেন তার জীবনের তিপ্পান্ন বছর, সাতমাস, এগারোটা দিনরাত্রি ধরে এই উত্তরটাই প্রস্তুত করে রেখেছিল -
"চিরটাকাল"