সব নিয়ে লড়াই চলুক। তর্ক চলুক। প্রশ্ন উঠুক।
শুধু সব কিছুর শেষে যেন মানুষের আত্মসম্মানটাই জয়ী হয়। সেটুকু বেঁচে থাকলেই সে বাকিটা আবার তৈরি করে নিতে পারবে। অঙ্গুরিমালকে বুদ্ধ কোনো যাদুবলে ফিরিয়ে আনেননি, এনেছিলেন তাকে তার নিজেরই দুষ্কর্মের দ্বারা প্রায় হারিয়ে যাওয়া আত্মসম্মানবোধকে ফিরিয়ে দিয়ে। বলেছিলেন, সে আবার সুকর্মের দ্বারা তার আত্মসম্মানবোধকে ফিরে পেতে পারে। জগাইমাধাই গল্পেও তাই। দুষ্কর্ম মানুষের আত্মসম্মানবোধকে নামিয়ে, ডুবিয়ে এমন করে ফেলে যে সে লজ্জাবোধটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। দুষ্কর্ম্মের পাঁকে ডোবে আত্মসম্মানবোধ।
আজ আবার করে যে নানা রঙ, ধর্ম, প্রথা, অভ্যাস, রীতিনীতি ইত্যাদি নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছে, বেশ বোঝা যাচ্ছে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের আত্মসম্মানবোধটা শুধুমাত্রই আমাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত। আমার ধর্ম, সমাজ, পরিবার, প্রথা, অভ্যাস, রীতিনীতি এ সবের বাইরে আমার একটা মানুষ হিসাবে আত্মসম্মানবোধ আছে। সে শুধু আমার ব্যবহার আমার সংকটকালে নেওয়া সিদ্ধান্তের উদারতার উপর নির্ভর করে, আর কিছুর উপর নয়। তাই কৃষ্ণ, মহম্মদ, বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, রামকৃষ্ণ, চৈতন্য, নানক প্রমুখেরা কাউকে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান-শিখ হতে বলে না। বলে মান আর হুঁশ নিয়ে মানুষ হও।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, মানে গানে বলছেন, "থেকেও সে মান থাকে না যে, লোভে আর ভয়ে লাজে/ ম্লান হয় দিনে দিনে যায় ধুলাতে ঢেকে ঢেকে"।
আমাদের শিক্ষা আমাদের আত্মসম্মানবোধের জাগরণের পীঠস্থান হোক। আমাদের আরো অন্ধকারের দিকে না ঠেলুক। আমাদের কেউ যেন না শেখাক, আমার আত্মসম্মানবোধ আমার পোশাকে, আমার নানা সামাজিক প্রথা মেনে চলায়। আমার আত্মসম্মানবোধ শুধুমাত্র একটা শর্তেই, আমি বিচার-বিবেচনার আলোর রাস্তায় বেছে নেব? না কি শুধুমাত্র প্রাচীনত্বের, ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে নিজের আত্মসম্মানকে তার সঙ্গে জড়িয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেখব? এ প্রশ্ন সবাইকে নিজের জন্য নিজেকে করতেই হবে। আমার কাজকে প্রভাবিত করবে শিক্ষা। আমার শিক্ষা হবে তা-ই যা আমার মধ্যে থাকা যা ভালো তাকে স্বীকার করতে শেখাবে। সে 'ভালো' কোনো অথোরিটির মানদণ্ড অনুযায়ী হবে না। সে 'ভালো' হবে যুক্তিনির্ভর, স্বচ্ছ, আমার মনুষ্যত্বের মানকে আরো সজীব করে। আর কোনো কিছুকেই অকারণে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দিয়ে। এইটুকুই সত্য - জন্ম হউক যথাতথা, কর্ম হউক ভালো।
মানুষের হাতে সত্যি বলতে দুটোই তো উপায়, ভালো কাজ, আর খারাপ কাজ। ভালো কাজে দুনিয়া স্বর্গ হয়ে যায় না। ভালো কাজে নিজের কাছে নিজের মানটুকু থাকে। সেটুকুই পরিচয় হোক না। বাকি তো শুধুই মোহ। আছে বলে মনে হলেই আদতে নেই। সে সব কিছু কতটা প্রাসঙ্গিক?