Skip to main content

এত হাসতে আমি লোকটাকে কবে দেখলাম? মনে পড়ে না। তার দুঃখের কারণ অনেক। সুখের কারণ নেই বললেই চলে, বা একটাই কারণ এখনও শরীরটা সাথ দিচ্ছে তার।

সেই লোকটাকে হাসতে দেখলাম। মানুষ শুধু না খেয়ে রোগা হয় না। অবহেলাতেও হয়। রুগ্ন হয়। সে তেমন রুগ্ন। তার আশেপাশে কেউ নেই যে তাকে ভালোবাসে। লোকটার বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়েছে। টাকাপয়সা তেমন কিছু নেই। সংসারে কেউ নেই বলেই হয় তো টাকাপয়সার সুখে মন নেই। সপ্তাহ পার হয়ে যায়, দাড়ি কাটে না। একা একা সাইকেল নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। একবাক্যে। চোখ দুটো তার যতটা বাইরেটা দেখে তার থেকে বেশি মনের আঘাত সহ্য করতে থাকে। তার চোখ দেখে মনে হয় এক রুগ্ন সিংহ চিড়িয়াখানায় আটকে। রাতদিন গ্রিলের ধারে বসে থাকে। কেউ গ্রিল খুলে দেবে, তার জন্য না। তার বাইরে ভিতরে কোথাও কিছুতে উৎসাহ নেই বলে সে বসে থাকে। হয় তো গ্রিল খুলে দিলেও বসে থাকত ওইভাবে।

সেই লোকটাকে হাসতে দেখলাম। তার ভাঙা চোয়ালগুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে, সাদা ছোটো-ছোটো দাড়িগুলো কাঁপিয়ে সে হাসছে।

সে সুখী হতে পারত কিনা জানি না। সে নিজের দুঃখে কাঁদে না এতটা জানি। ওসব ওর ধাতে নেই। দুঃখ যত চড়াও হয় ওর উপর, ওর চোয়ালদুটো তত শক্ত হয়। সাইকেলটা চালায় মাটির দিকে তাকিয়ে। যেন হাতুড়ে ডাক্তার বিনা অ্যানেস্থেসিয়ায় ওর পিঠের একটা বড় ফোঁড়া কাটছে। ও পেশী শক্ত করে সহ্য করছে।

এটা হয় না? হয় তো। বিনা অ্যানেস্থেসিয়া কত বড় বড় অপারেশান করে দেয় ভাগ্য। মা বসে আছে ছেলের পোস্টমর্টেম ঘরের বাইরে। কাটছেঁড়া শরীরটা নেবে বলে। দেখেছি তো। কাঁদছে না। তাকিয়ে আছে। কিন্তু ওর দিকে তাকাতে পারা যাচ্ছে না। এই লোকটার জীবন থেকে সবাইকে কেড়েছে মৃত্যু শুধু না। বিশ্বাসঘাতকতাও। এমনকি যে বাচ্চাগুলোকে ভালোবেসেছিল এককালে, আত্মীয়দের বাচ্চাই, তারাও আসে না। তবে শুনেছি টাকা লাগলে নাকি চায়। বেশি টাকা তো ওর নেই। ওই খুচরো টাকা। লোকটা দেয়। ব্যবহার হতে দেয় নিজেকে। ভালোবাসার যদি অধিকার নেই তার উপর, তবে এইভাবে ব্যবহৃত হতে দিতে দোষ কী নিজেকে?

সে যখন বাচ্চাগুলোকে টাকা দেয়, মানে অন্যায্য টাকা দেয়, তার চোখে নাকি তখন একটা মায়ার মত কী জন্মায়। যেন মরুভূমিতে মেঘের ছায়া পড়েছে। অল্পক্ষণের জন্য হলেও ছায়াটুকু নাকি থাকে।

সেই লোকটাকে সারাটা শরীর কাঁপিয়ে হাসতে দেখলাম। চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিল প্রায় এমন হাসি। রাস্তার ধারে বসে, হেসেই যাচ্ছিল। না না পাগল হয়নি। বন্ধুদের সঙ্গে বসে হাসছিল। পাগল ও নিজেকে হতে দেবে না। সহ্য করার মত হৃৎপেশীতে জোর আছে ওর।

লোকটা কাউকে ঠকায়নি নাকি আজ অবধি। আমি না, ওর পাড়ার লোকের কাছে শুনেছি। লোকটা মিষ্টভাষী নয়, কেউ কেউ সেও বলল। কিন্তু মিষ্টি কথায় লোক ঠকানো তো কোনো কাজের কথা নয়। তাই আমি তার অমিষ্টভাষিতাকে দোষের মধ্যে ধরলাম না। বলুক কড়া কথা, কিন্তু না ঠকাক কাউকে।

একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, ওর আত্মীয়েরা যখন এত অপমান করে ওকে, ও কিছু বলে? মানে ওদের বাড়ি গিয়ে ঝগড়া করে?

কেউ কেউ বলল, ওর নাকি সে মুরোদ নেই। আবার কেউ কেউ বলল, ওর ভীষণ আত্মসম্মানবোধ। কী আশ্চর্য সংসার না? বাইরে থেকে একটা লোক অপমানের ঘা দেখায় না বলে, কেউ বলল, ওর নাকি ফিরে অন্যের বুকে ঘা দেওয়ার মুরোদ নেই। আবার কেউ বলল, ওর নাকি আত্মসম্মানবোধ ভীষণ। আচ্ছা বলো, এমনও তো হতে পারে, ও মনে মনে অপমানগুলো নিয়ে ভাবে। না না, সব সময় ভাবে কই বললাম। কিন্তু হয় তো ভাবে। রাতে শুতে যাওয়ার আগে। কিম্বা খুব বৃষ্টি বাড়ি থেকে বেরোতে পারছে না, তখন একা একা চায়ের কাপ নিয়ে ভাবে। ভাবে কেন ওরা এত অপমান করে তাকে? এত অবহেলা কেন করে? (আমার কথা চাপাচ্ছি ওর ভাবনায়? ধুর!)

কারণটা ধীরে ধীরে জানতে পারলাম। সে একদিন ভীষণ বোকা ছিল। যে বোকা সে বাস্তবটা মনের ঝোঁকের হিসাবে দেখে। আর যে চালাক সে বাস্তবটা স্বার্থের হিসাবে দেখে। কেউ তাকে বলল, আমার এই কাজটা ব্যাঙ্কে গিয়ে করে দিয়ে আয় তো। অমনি সে দৌড়াত। কারণ ও ভাবত, সে না গেলে হয় তো কাজটাই হবে না। কিম্বা হয় তো ভাবত, খুব দরকার না হলে তাকে ব্যাঙ্কে পাঠাবেই বা কেন? এইভাবে সে মনের রঙে দেখত। তাই যে যেভাবে খুশি তাকে ব্যবহার করে নিত। রঙ তার টাটকা ছিল বলে।

কিন্তু একদিন সে কী করে জানি বুঝে গেল। লোকে বলে তাকে নাকি কেউ একজন ভালোবেসেছিল। সে তার চোখ-মন ছেনে ছেনে তাকে দশদিকের দুনিয়াদারি শিখিয়েছিল। ব্যস। অমনি লোকে তার উপর রাগতে শুরু করেছিল।

এটা হয় আমি দেখেছি। যে মানুষটা রোজ পাড়ার কুকুরদের ডেকে খেতে দেয়, তার ডাকে কোনো কুকুর যদি সাড়া না দেয়, বা অন্যবাড়ি খেতে যায়, ব্যস, তার শাপশাপান্ত করে ছাড়ে। আসলে সে মানুষকে ভালোবাসার চাইতে কুকুরকে ভালোবেসে শান্তিতে কাটাবে ভেবেছিল। মানুষকে ভালোবাসার ঝক্কি তো অনেক। তার চাইতে কুকুরকে ভালোবাসা সহজ। তক্কো করে না। অনুগামী হয়ে, লেজ নেড়ে, এটাসেটা করে সুখ দেয়। আর তার সঙ্গে নিজের উপর সবটুকু অধিকার ফলানোর ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। মানুষ আর কী চায়? ভালোবাসা আর তার অনুষঙ্গে একটা স্বেচ্ছায় দেওয়া অধিকারের জমি। তার দেখভাল করবও আমি, ফসল কাটবও আমি। ওগো তুমি যে আমার!

লোকটার জেগে ওঠা লোকটাকে একা করে দিল। সত্যবাদিতায় ঘর পোড়ে। তাই লোকে ভদ্র হতে বলে। ধার্মিক হতে বলে। অনুভবের আটপৌরে আমিষ-নিরামিষ সত্য থেকে দূরে থেকে পবিত্র-মহান সত্যে বিশ্বাস রাখতে বলে। ওতে ঘর বাঁধা যায়। লোকটা পারেনি। তাই পুড়েছে। তবে পোড়ায়নি কাউকে। অমিষ্টভাষী হয়েছে। কিন্তু জ্বালামুখী হয়নি। ও অপমান করে না কাউকে।

সেই মানুষটাকে হাসতে দেখলাম বন্ধুদের সঙ্গে বসে আড্ডায়। দুটো চোখ হাসতে হাসতে ছোটো হয়ে যাচ্ছে। চোয়ালে কাঁপুনি ধরেছে। সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। এত আনন্দ কেন তার? কারণ তার কয়েকজন বন্ধু আছে দেখলাম। আগে জানতাম না। এই প্রথম মনে হল, লোকটাকে একদিন রাস্তায় দেখা হলে ডাকব। জিজ্ঞাসা করব, কেমন আছেন? বন্ধুরা কেমন আছে?

উত্তর দেবে দিক। না দিলে না দিক।