সবুজ গেঞ্জি, এতটাই বড় যে প্যান্ট না পরলেও চলে, সে পরেওনি। রোগা কালো শরীরটা সোজা দাঁড়িয়ে বড় মানুষদের হাঁটুও ছুঁতে পারেনি। তার এক হাতে চকমকি কাগজের গরম চা, আর এক হাতে দুটো বিস্কুট। একটা তার, একটা বাবার।
সে ফিরছে। ধীরে ধীরে পা ফেলেই ফিরছে। রাস্তায় ভিড় নেই তেমন, তবে লোক আছে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, রাতের দিকে তাকিয়ে রাস্তার টিউবলাইটগুলো। ওরা রাতে একা হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে। দিনের বেলা ঘুমায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই।
হঠাৎ কিসের আওয়াজ?
একটা ভ্যান আসছে। কি জোরে চালাচ্ছে লোকটা! ভ্যানের উপর অনেকগুলো লোহার রড চাপানো। সেগুলো এতটা বড় যে ভ্যানের এদিক ওদিক ছাড়িয়ে গেছে। পিছনের দিকে রডগুলো রাস্তার সঙ্গে ঘষে ঘষে যাচ্ছে। কি দারুণ, ফুলঝুরির মত আগুন ছিটকাচ্ছে….
সে দৌড় লাগালো ভ্যানের পিছন পিছন। তার সামনে লোহার রডগুলো নাচতে নাচতে, রাস্তায় ঘষতে ঘষতে যাচ্ছে আর বলছে…দেখ দেখ কেমন ফুলঝুরি… ধর… ধর… ধর…..
থার্ড এভিনিউ… সেকেন্ড এভিনিউ…. ফার্স্ট এভিনিউ… সব পেরিয়ে যাচ্ছে ভ্যানটা…. এরপর? কোথায় যাবে? ওদিকে তো ইয়াব্বড় বড় কুকুর…..
থমকে দাঁড়ালো সে। অন্ধকারে ফুলঝুরিটা মিশে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তার মন খারাপ হয়ে গেল।
=====
বাড়ি ফিরছে। প্রথমে শিবের মন্দির। তারপর কালীর মন্দির। তারপর শনিঠাকুরের মন্দির। তার শনিঠাকুরকে খুব ভালো লাগে। প্রত্যেক শনিবার খিচুড়ি হয়। ফল কাটা হয়। তাকে দেয় বিকাশ ঠাকুর।
চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বাবা মারবে। মারবেই।
সে শনিঠাকুরের মন্দিরের সামনে দাঁড়ালো। বলল, আমি কি করব বলো…. ওই লোহার ফুলঝুরি….
ট্রেন যাচ্ছে পাশের লাইন দিয়ে। শনি ঠাকুর কি বলল শুনতে পেল না। সে চা আর বিস্কুট নিয়ে দোকানের দিকে এগোলো। বাবার সেলুন।
=====
বাবা তার দিকে আড়চোখে তাকালো। একটা বাচ্চা চুল কাটাতে এসেছে। রেল কলোনির কেউ হবে। কিন্তু রাতে তো বাচ্চারা কাটে না!
এত দেরি হল?
সে আমতা আমতা করে লোহার ফুলঝুরির গল্পটা বলতে শুরু করল। জানে বিশ্বাস করবে না, তবু। চা টা বাবার কাপে ঢালতে ঢালতে দেখল…. ইস… সত্যি ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে… বাচ্চাটা বড় বড় চোখ করে তার গল্প শুনছে…. ওর বাবা বাইকে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে আর মোবাইল ঘাঁটছে।
আচমকা ওর বাবা কাঁচিটা রেখে বলল, চায়ের কাপে হাত দিল… তারপর ছুঁড়ে ফেলে দিল রাস্তায়…. এক দু ফোঁটা হয় তো বাচ্চাটার বাবার গায়ে লাগল…. সে রেগে বলল, আরে অন্ধ নাকি….
বাবা… সরি সরি বলে তার কান ধরে যেই না চড় মারতে যাবে অমনি দেওয়ালে দুটো টিকটিকি দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে একটা বাবার পিঠের দিকে ঝোলানো শার্টের কলারের মধ্যে ঢুকে গেল। বাবা, ওরে রাম…. বলে এক লাফে দোকানের বাইরে…. সেও এই ফাঁকে রাস্তায়…..
জানে, এটা শনিঠাকুর করল। কিন্তু তার কথা, তার গল্প কেউ বিশ্বাস করে না।
======
কোথায় যাবে এখন? রোজ যেখানে যায়।
থার্ড লাইন বসেছে তার বাড়ির সামনেই। আগে দুটো লাইন ছিল কাঁচরাপাড়া স্টেশানে যেতে। এখন আরেকটা লাইন হয়েছে। এই লাইনটা যখন পাতা হচ্ছিল কতরকম গাড়ি আসত। খেলনার মত। কি বড় বড় হাত গাড়িগুলোর সামনে। রাতে সে আর তার বন্ধুরা খেলত গাড়িগুলোতে চড়ে। এখানেই রাখা থাকত তো।
সে থার্ড লাইনের পাশে একটা ঢিবি আছে, তার উপর উঠে বসল। এখানে খুব হিসির গন্ধ। যা হোক বাবা অন্তত এদিকে আসবে না।
সামনের এই থার্ড লাইনে তার ঠাকুমা জামাকাপড় কেচে মেলত। তখন ট্রেন চালু হয়নি তো। শীতের দুপুরে এখানেই বসে ভাত মেখে খেত। তার ঠাকুমার চোখে ছানি ছিল, কানেও কম শুনত। তাই তো থার্ড লাইনে ট্রেন আসছে শুনতে পায়নি। শীতের দুপুরে কম্বল জড়িয়ে শুয়েছিল।
সে জানে একটু পরেই ঠাকুমা আসবে। রোজ আসে। তার সঙ্গে গল্প করে। এখন ঠাকুমা চোখেও দেখে, কানেও শোনে, একদম রঞ্জনের ঠাকুমার মত। রঞ্জনের বাবা রিকশা চালায়। তার মা নেই। ঠাকুমা আছে।
=====
ঠাকুমা এসে বসল তার পাশে। সে যা যা ঘটেছে সব বলল। রোজ বলে। সে যখন শুতে যায় পাশে এসে ঠাকুমা শোয়। সে কথা বলে, সারাদিনের গল্প বলে। তার মা বলে কার সঙ্গে বকবক করছিস পাগলের মত….
আগে বলত, "ঠাকুমার সঙ্গে কথা বলছি"…. এখন উত্তর দেয় না…. কি হবে… ওরা তো বিশ্বাসই করবে না…..
ঠাকুমা সব গল্প শুনে রেললাইনে নেমে গেল। দুটো পাথর এনে ঠুকে ঠুকে আগুনের ফুলকি জ্বালিয়ে দেখালো। বলল, তুই কর….
সে পারছে না। কিছুতেই পারছে না।
আমায় দে….
তার বাবা দাঁড়িয়ে পিছনে। সে পাথর দুটো দিল। বাবা ঠস ঠস করে ঠুকে আগুনের ফুলকি বানালো।
বাবা পকেট থেকে তার বিস্কুটটা বার করে হাতে দিয়ে বলল, চ… বাড়ি চ….
সে বলল, চা….?
তার বাবা মাথায় চাঁটি মেরে বলল, হিসাব রাখ…. বড় হয়ে আমায় খাওয়াবি…. নিজের টাকায়…
সে সেদিন রাতে স্বপ্ন দেখল, সে ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছে… লোহার রডগুলো ভ্যানে শুয়ে শুয়ে রাস্তায় ফুলঝুরি বানাতে বানাতে যাচ্ছে…. বাবা তার মত ছোট্টো হয়ে দৌড়াচ্ছে পিছনে পিছনে।
সে ভ্যান থামালো। ভ্যানে উঠল বাবা। দেখে ঠাকুমা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে, ভ্যানেই।
বাবা বলল, দাঁড়া তোর মাকে ডেকে আনি….
সে দেখে, মা রেললাইনে বসে বসে পাথর ঠুকে ঠুকে আলো জ্বালাচ্ছে, আর যে ট্রেনটা ঠাকুমাকে কেটে দিয়েছিল…. শনিঠাকুর তাকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছে।