সৌরভ ভট্টাচার্য
20 June 2020
লকডাউনের শুরুতে একটা লেখায় আশঙ্কা প্রকাশ করি – অনলাইন ক্লাস নিয়ে। মনে হয়েছিল অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের জন্য কিছু কিছু দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আজ দেখছি তা ঘটছেও। হয়তো নানা কারণে আমরা অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত বলে সেই ঘটনাগুলো নিয়ে তেমনভাবে আলোচনা করার, দিশা খোঁজার দরকার মনে করছি না, কিন্তু ঘটছে। না তাকাতে পারি, অস্বীকার করতে পারি না।
শিবানী কুমারী শাউ। বয়েস ষোলো। হাওড়ায় বাড়ি। গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছে। কারণ, যে স্মার্টফোনে অনলাইন ক্লাস করত, সেই ফোনটা ভেঙে গিয়েছিল। বাবা বাড়ি থাকে না। তাও ফোনে বলেছিল, আমার ক্লাস করতে অসুবিধা হচ্ছে, যদি একটা ফোন কিনে দাও। বাবা কথাও দিয়েছিল দেবে, বাড়ি এসেই দেবে। কিন্তু আসতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওদিকে পড়া এগিয়ে চলছে তরতর করে। যদি ফেল করে যাই, যদি ধরতে না পারি? এই ভাবনা থেকে অবসাদ। তারপর এই চরম পরিণতি। আজকের টাইমস অব ইণ্ডিয়ায় দ্বিতীয় পাতায় আছে।
এ তেমন কিছু বড় ঘটনা না জানি। দেশ এখন একটা অত্যন্ত মর্মান্তিক আত্মহত্যার ধাক্কা সামলাতে কাহিল। তার ওপর করোনার নিত্যনৈমিত্তিক ধারাবিবরণী তো আছেই, সাথে নতুন চীনের উপদ্রব। গোদের উপর বিষফোঁড়া মত যাদের শুদ্ধ-অপাপবিদ্ধ চরিত্রের উপর নির্ভর করে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি তৈরি, সেই মহান টলিউড আর বলিউডের মহাত্মাতুল্য মানুষদের চরিত্রস্খলনের একের পর এক ঘটনার অভিঘাত তো আছেই।
সেখানে কে শিবানী? কি তার কেরিয়ার? কি তার স্মার্টফোন থাকা না থাকা? একটা অত্যন্ত সাধারণ, মানে গরীব পরিবারের, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ের, অত্যন্ত সাধারণ মৃত্যু। এই নিয়ে এত হাপিত্যেশ করার কি আছে? কেন এই অনলাইন ক্লাস শুরুর আগে ছাত্রছাত্রীরা আত্মহত্যা করত না? কম নাম্বারের ভয়ে, মাষ্টারের বকুনি খেয়ে, ব্যর্থ প্রেমের কারণে ইত্যাদি ইত্যাদি...তা হঠাৎ করে অনলাইন ক্লাসের দিকে আঙুল তোলা কেন বাপু? একটা পরিবর্তনে, মহামারী বা অতিমারী যাই বলো, এমন একটা টালমাটাল সময়ে সব সভ্যতার ইতিহাসে এমন অনেক খুচরো মৃত্যু পাবে, তাই নিয়ে এমন কিছু বাড়াবাড়ি না করাই ভালো।
কথাগুলো নিশ্চয়ই ঠিক। কিন্তু তবু কয়েকটা কথা না বলেই পারছি না। না পড়লেই হল ইচ্ছা হলে। পাশ কাটিয়ে গেলেই হল। কিম্বা পড়ে বা না পড়ে একটা রিয়্যাকশান কিছু দিয়ে ভুলে গেলেই হল। কিন্তু তবু একটা মৃত্যু তো মৃত্যুই। অকাল মৃত্যু। নিজের ব্যর্থতার জন্য অবসাদ না, সে প্রেমেই হোক কি পরীক্ষায়। ব্যর্থতা না, একটা সমাজের উদাসীনতাই যেন দায়ী কোথায়। আমার অন্তত তেমনই যেন মনে হচ্ছে।
আমি অনলাইন ক্লাস করাই। আমার কোনো ছাত্রছাত্রী যদি একটা দিন ক্লাস কামাই করে তার বন্ধুবান্ধবদের থেকে খোঁজ নিতে চেষ্টা করি, সে ঠিক আছে কিনা। ধরা যাক কোনো স্পষ্ট উত্তর পেলাম না। তখন তাকে সরাসরি ফোন করি। কারণ মনে একটা চিন্তা থাকে। অনলাইন ক্লাস করতে একটা নির্দিষ্ট ডেটাপ্যাক লাগে। অনেকের পরিবারের প্রধান উপার্জনশীল মানুষটির হয় তো কাজ নেই। তাই কি সে ক্লাস এল না? হতেই তো পারে। কথা বলা যাক। এখন অনেক কোম্পানি ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ এর প্যাক এনেছে। ১৫১/- টাকায় তিরিশ জিবি প্যাকও আছে তার মধ্যে, সর্বাধিক গ্রাহক যে কোম্পানিটির বর্তমানে, তার স্কিমে। সেটা যদি একটু সাহায্য করা যায়? যায় না? খুব যায়। এমনও হতে পারে তার প্যাকটা শেষ হয়ে গেছে, আর চারদিন পর বাড়ির লোক বলেছে রিচার্জ করে দেবে। সেই কদিনের মধ্যে যদি কোনো ক্লাস পড়ে যায়, তাকে একটু কাছে ডেকে নিলেই হয়, কিম্বা সেটাতে অসুবিধা থাকে তাকে একটু ফোনে এইটুকু আশ্বস্ত করলেই হয় তুই ঘাবড়াস না, আমি ওটা করিয়ে দেব। হয় না? খুব হয়। আরো একটা জিনিস, ক্লাসের সময় যদি উভয় পক্ষের ভিডিওটি অফ করে দেওয়া যায়, শুধুমাত্র স্ক্রিনটা শেয়ার করে পড়ানো যায়, সেখানেও দেখেছি অনেক কম ডেটা খরচ হয়, আর আমার স্ক্রীণটা বেশ ব্ল্যাকবোর্ডের মত তাদের সামনে তাদের বাড়িতে ফুটে ওঠে।
শিবানী যদি ক্লাস টেনের অনলাইন ক্লাসে কোনো শিক্ষকের কাছে কয়েকদিন অনুপস্থিত ছিল, তবে আমার মনে হয় সেই শিক্ষকের দায়িত্ব ছিল একটু ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফোন করে খোঁজ নেওয়া। যদি ফোনে না পাওয়া যাচ্ছে একটু কষ্ট করে তার বাড়ি যাওয়া, বা যে কোনোভাবে তার সাথে যোগাযোগ করা। তার কোনো বন্ধুকে বলা, তুই ওর বাড়ী গিয়ে তোর ফোন থেকে আমায় একটা মিসড করিস, আমি কল করে ওর সাথে কথা বলে নেব। তাকে এইটুকু অন্তত বলে আশ্বস্ত করা যে সে খাদের দিকে নেই। সে একা নয়। তার ভয়, তার আশঙ্কার কথা আমিও বুঝি, আমি আছি, কিছু হবে না। আমরা ঠিক সামলে নেব।
আপনি বলবেন এত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এটা করা সম্ভব নয়। আমি বলব, এই ‘এত’ শব্দটা খুব আপেক্ষিক। কেউ ক্লাসে প্রতিটা ছাত্রছাত্রীর নাম জানেন, কেউ মাত্র কয়েকজন হাতে গোনা, কেউ বা তাও না। বিশেষ করে এই সমস্যাটা হয় একদম নীচু ক্লাস থেকে শুরু করে মাধ্যমিক অবধি, আরেকটু টেনে বললে উচ্চামাধ্যমিক অবধি। মাধ্যমিক অবধি তো এই কথাটা অবশ্যই মনে রাখতে হয় আমি যে মানুষগুলোর সাথে আমার শিক্ষার সম্পর্কের আদান প্রদান গড়ে তুলেছি তারা পরিপূর্ণ মানুষই হয়ে ওঠেনি এখনও। তাদের আবেগের, অভিমানের উপর সেই নিয়ন্ত্রণ জন্মায়নি এখনও, তাদের বিচার-বিশ্লেষণের মন সদ্য কুঁড়ি হয়েছে কেবল। সেই বিকাশমান মানুষের অনুভব ভীষণ কোমল, স্পর্শকাতর।
এই দুর্যোগের মধ্যে, এই দুর্দিনে তাই আমরা যারা শিক্ষকতা করছি আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি মনে হয়। আরেকটা উদাহরণ দিই। আমার এক বন্ধুর মেয়ে, একেবারেই ছোটো, সে স্কুলের অনলাইন ক্লাস করছে। আমার বন্ধু হঠাৎ ঘরে ঢুকে দেখে, ল্যাপটপে ক্লাস চলছে, সে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে, তার চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে, সে নিঃশব্দে কাঁদছে। কারণ কি? কারণ মিস যে প্রশ্নগুলো করছেন, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর সেও তো ঠিক দিচ্ছে, কিন্তু মিস অন্যদের গুড বলছেন, তার নাম নিচ্ছেন না কেন? আমার বন্ধুটি তখন ল্যাপটপের কাছে গিয়ে দেখে তার মাইকটা অফ করে রাখা, তাই সে যা বলেছে তা মিসের কান অবধি পৌঁছায়নি।
এরকম অজস্র ঘটনা আর তার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তা সামাল দেওয়ার জন্য কোনো অতিমানবিক স্কিলের দরকার নেই, আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি। ভালোবাসতে পারলেই হল। তখনই বোঝা যায় সীমাবদ্ধতা, অপারগতা, অসহায়তাটা একটা ঘটনা না, একটা যন্ত্রণা, একটা অপমানবোধ, একটা ভয়, একটা হীনম্যতা। তার হাল খুঁজতেও কোনো জটিল মনস্তত্ব বুঝতে হয় না, শুধুই ভালোবাসাটুকুই সবটা দেখিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয়। একবার ফোন করে বললেই হয়, আমি আছি, ঘাবড়াস না...অমনি তার গলার স্বর বদলে যায়, সে আবার তার বাঁদরামির মোডে ফিরে যায়। বাচ্চাগুলোর বাঁদরামিটুকু বাদ দিলে আসল আর কি পড়ে থাকে বলুন? তাই আমার একান্ত অনুরোধ, এই দুর্দিনে ওদের ঢাল হোন। ওদের অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচান। একটু বেশি সক্রিয় সতর্ক হোন। কারণ ওরা একটা পরিবারের বাচ্চা নিশ্চয়, কিন্তু আমাদের সমাজেরও তো অংশ, সেটি অস্বীকার করা যায় কি? কোনো প্রতিষ্ঠান কি করল, কে কতটা সাহায্য করল, কে কিরকমভাবে এগিয়ে এলো, না পিছিয়ে গেল, সে সব দেখার দরকার নেই। ভালোবাসাটা সমষ্টিগত হয় না, ওটা ব্যক্তিগত অনুভূতিই চিরটাকাল। আর ওই ভালোবাসাই কর্তব্য ঠিক করে, রাস্তাও বার করে দেয়। নাই বা গেল আর একটাও প্রাণ, অন্তত আপনার আমার আওতায় যারা আছে, একটু কি চেষ্টা করা যায় না?