[স্থান, লোকাল ট্রেন। দুই বক্তা পঞ্চাশোর্ধ, সচ্ছল, পুরুষ।]
- দীক্ষাটা এবার নিয়ে নেব ভাবছি
- নিয়ে ফেলুন, আমি আর আমার গিন্নী দুজনেরই তো নেওয়া আছে। ছেলেটাকেও দিয়ে দিলাম। কলেজে ভর্তি হল তো।
- তাই?
- হুম, ভালো রেজাল্ট, ভালো খেলেও, ক্রিকেটের জন্য সেই রাণাঘাট থেকে প্রথম ট্রেনে কলকাতায় নিয়ে আসতাম। কম ঝক্কি পোয়াতে হয়েছে!
- তা বটে
- তবে কি গুরুদেবের কৃপায় আর ঠাকুর-মা-স্বামীজির কৃপায় ভালো খেলছে, নামটামও হচ্ছে, এবার একটা ভালো চাকরিটাকরি জুটে গেলে আমরা নিশ্চিন্ত। তখন ওই তীর্থটীর্থ নিয়ে থাকব।
- তা বটে, তাহলে আপনারা রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত?
- হুম তো
- আমার বড়মামা ছিলেন, বিয়ে করেননি, খুব মঠে যাতায়াত ছিল। আমি ভাবছি আমাদের কূলগুরুর কাছে যাব এই মহালয়ার দিন।
- কোথায়?
- বীরনগর
- ছেড়ে দিন
- মানে? ( বক্তার চোখে বিস্ময়)
- বলছি বৈষ্ণব মতে তো?
- হুম, আমাদের বাড়ির সবাই তো..
- ছেড়ে দিন ( বক্তা দুই প্যাকেট বাদাম কিনলেন, এক প্যাকেট আরেককে দিয়ে নিজে দুটো বাদাম মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বললেন)
- জিনিসপত্র ব্র্যাণ্ডেড কেনেন তো?
- তা কিনি
- কারণ কি?
- অথেনটিক হয়
- গুরু তবে নন ব্র্যাণ্ডেড হবে কেন?
- বুঝলাম না
- ধরুন রামকৃষ্ণ, ওমকারনাথ, নিগমানন্দ, আনন্দময়ী এরা হলেন ব্র্যাণ্ডেড, একটা নাম আছে।
- কিন্তু ঈশ্বরের সাথে এর কি সম্পর্ক?
- আছে বইকি, ভালো জায়গায় রেজিস্ট্রী করলে জমিজায়গা পাকাপোক্ত হয়, নইলে কে কোথায় কখন খেদিয়ে দেয়, এমনিতেই তো কিসব NRC হচ্ছে শুনছি। সেখানেও তাড়ালে তো বিপদ
- তাও বটে, কিন্তু... ( কনফিউজড) আমাদের একটা বংশের নিয়ম প্রথা আছে...
- সেসব কিছু নয়, ভ্রম। আসল হল, এই ব্র্যাণ্ড। যেমন ধরুন রামকৃষ্ণ হলেন এখনকার অবতার, এখন ওনাকে নিয়ে চললেই হবে।
- কিন্তু সাঁই, ওমকারনাথ, অনুকূল ঠাকুর, সবাইকেই তো এই যুগের অবতার বলে তাদের শিষ্যেরা
- উঁহু, ওটা সেন্টিমেন্ট, ওতে আঘাত দিতে নেই। ধর্ম একটা সুক্ষ্ম নরম সেন্টিমেন্ট, বিশ্বাস, যুক্তির কথা নয়, কিন্তু আপনি দেখুন রামকৃষ্ণের প্রচারটা যত বিশ্বজুড়ে বাকিদের কি অত?
- কেন ইসকন?
- হুম, তা বলতে পারেন, তবে শুধু মার্কেটিং দেখলে হয় না, মার্কেটিং এর কোয়ালিটিও দেখতে হয়
- আমি লোকনাথবাবাকে খুব ভক্তি করি, আমার গিন্নীও করেন
- এই তো একটা কাঁচাকথা বলে ফেললেন
- মানে?
- লোকনাথবাবা তো সিদ্ধপুরুষ, অবতার নয়?
- কিন্তু উনি যে শিবের অবতার বলে?
- সেই সেন্টিমেণ্টের ফাঁদে পা দিচ্ছেন দাদা, আসল হল অবতারবরিষ্ঠায়, মানে কে? রামকৃষ্ণ। কে বলেছে? স্বামীজি।
- সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে যে
- সে তো গুলাবেই, আগে গুরুকরণ করে নাও
- কিন্তু কোন ব্র্যাণ্ডে যাব দাদা?
- আগে মঠমিশন, আশ্রম ইত্যাদিতে যান। দেখুন কাদের মালকড়ি বেশি, সেদিকেই ঝুঁকবেন, ক্লাস বলে তো একটা ব্যাপার আছে।
- আবার ক্লাস?
- নেই! আপনি কোন অবতারের দীক্ষিত, কোন মহারাজের দীক্ষিত, এইসবের সাথে আপনার স্টেটাস জড়িয়ে নেই? অবশ্যই আছে। ধরুন আপনার অফিসের টেবিলের উপর আপনি আপনার বীরনগরের গুরুদেবের ছবি রেখেছেন, দেখবেন লোকে আপনাকে নিয়ে কেমন খিল্লি করে...আপনার সামনে না হোক, পিছনে তো করবেই...
এই হরিদাকে মনে নেই। অনুকূল ঠাকুরের ওখানে দীক্ষা নিয়েছিল বলে কি খিল্লি করত বড়দা মেজদা ইত্যাদি বলে, তারপর বেলুড়ে দীক্ষা নিয়ে বাঁচল, নইলে এবারের পিকনিকে তো যেতই না..
ট্রেন দাঁড়িয়ে...কাঁকিনাড়া অবরোধ।
দুজনেই চুপচাপ। অফিস পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। প্রথম জন আবার বললেন, আপনি আসুন, আমি মঠে যোগাযোগ করে দীক্ষার ব্যবস্থা করে দেব। তারপর সব উন্নতি ঠাকুর দেখবেন।
ট্রেন দাঁড়িয়ে।
"মনে হয় শালাগুলোকে".উপদেষ্টার গলায় ঝাঁঝ..গালিগালাজ... ভদ্রলোক হেসে বলল,, ঠাকুরও দিতেন, কথামৃতে আছে...
অন্যজন মাথা নাড়ল।
উপদেষ্টা কয়েকটা ফোনের পর বলল, শালাবাবুর গাড়িতে চলে যাচ্ছি বুঝলেন, আপনি দেখুন কখন ছাড়ে... অফিসে দেখা হচ্ছে তবে...,আর ওই বীরনগরটগর ছাড়ুন...জাতে উঠুন মশায়...শুধু পয়সা আর ভালো চাকরিতেই জাত হয় না...একটা স্পিরিচুয়াল স্টেটাস লাগে...
উপদেষ্টা চলে গেল। আরেকজন বাদামের প্যাকেট হাতে অন্যমনস্ক।