"এই সময়টায় লাইব্রেরীতে বড় কেউ একটা ঢোকে না। এখন ক'টা হবে? চারটে দশ-টশ হবে। ওই তো বলরাম হাইস্কুলের ঘন্টা পড়েনি এখনও। এখন বিলুবাবু পেপার পড়ছেন। বিলুবাবু এখানকার নামকরা লোক ছিলেন (হ্যাঁ ছিলেন বলছি, কারণ তিনি বেঁচে নেই এখন), দেশে-বিদেশে বহু কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। আমি? আমি এই লাইব্রেরীর দেখাশোনা করি। মাসে দেড় হাজার টাকা দেয়। আর বিকালটা বিলুবাবুর দেখাশোনা করি বলে, উপরি পাঁচশো। চলে যায় কোনোমতে, তাছাড়া বাড়িতে একটা প্লাস্টিকের খেলনা বানানোর... ওই দেখুন, আমার গল্প জুড়ছি কেন? কথা হচ্ছে তো বিলুবাবুকে নিয়ে। পুরোনো কথাতে আসি।
আমি মাধ্যমিক ফেল। ওনার কাছে বাবা দিয়েছিলেন ইংরাজীটা শেখানোর জন্য, ক্লাস এইটে। বাবা ওনার ধোপা ছিলেন। বাবার ছিল দুটো গাধা (অবশ্যি অনেকে তিনটে বলত, কারণটা অনুমান করতে পারছেন), উফ্, আবার বাবার কথা নিয়ে পড়লাম! সে যাক, তা যখন আমি নাইনে পড়ি তখন হঠাৎ একদিন সকালে শুনি বিলুবাবু নাকি গলায় দড়ি দিয়েছেন। কারণটা বলতে পারব না। তবে যে ক'টা শুনেছি বলতে পারব। এক, ওনার প্রাণের বন্ধু হরিপদ মাষ্টার (ব্যাটা হাড়বজ্জাত লোক, লোকের টাকা কি সব ইন্সিউরেন্সে খাটাবে বলে নেয়, আর দেয় না... ওর কথা এখন থাক) বলে, বিলুবাবু নাকি এক ফরাসী দার্শনিক আর জার্মান দার্শনিকের তত্ত্ব মেলাতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। আমার বাপু বিশ্বাস হয় না। লোকে না পড়ে সুইসাইড করে, পড়ে আর কে কবে... যাক গে। দুই, কেউ কেউ বলে দত্তবাড়ির যে মেয়েটার সাথে ওনার ভাব ছিল, যাকে উনি বিয়ে করতে পারেননি বলে আর বিয়েই করেননি, তার জন্যেই নাকি শোকে। তা আমার কথা হল অ্যাদ্দিন পর কেন? না?... ভাবুন একবার, তখন ওনার গোটা পঞ্চাশ বয়েস হবে।
আওয়াজ শুনছেন? উনি গান গাইছেন। অতুলপ্রসাদী... কেন এলে মোর ঘরে আগে নাহি বলিয়া... আহা ভূত হলে কি হবে, কি গলা না? এই গানটা আমিও জানি, আমার বউ গায়। ও আরেকটা কথা, বউ বলতে মনে পড়ল। আমার বউ বলে উনি নাকি আমায় ইংরাজী পড়াবার শোকে আত্মহত্যা করেছিলেন। বুঝুন মেয়েমানুষের বুদ্ধি! তা এতবড় পৃথিবীতে আমার চেয়ে মুখ্যু আর নেই নাকি! যত ভুলভাল কথা! ছাড়ুন তো! (তবে মিথ্যা বলব না, মাঝে মাঝে আমারও কেমন সন্দেহ হয়, তাই কি? একেকবার ভাবি ওনাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু কি করে করি বলুন, একে মাষ্টার তায় ভূত!
আওয়াজ শুনছেন? উনি পায়চারি করছেন। অর্থাৎ কিছু একটা ভাবছেন। এখনি চা চাইবেন। ওই ডাকছেন, আপনি একটু বসুন, আমি এক দৌড়ে আসছি, আহা কদ্দিন পর একটা ভদ্রলোক দেখছি এ পাড়ায়। কি জানেন, বড্ড অহংকারী হয়ে গেছে মানুষজন আজকাল। আমি আসছি..."
"হ্যাঁ, চা দিয়ে এলাম। খুব খোশমেজাজে আছেন আজ। পুরো শরীরটাই সাথে এনেছেন। মন খারাপ থাকলে দেখেছি শুধু মাথাটা নিয়ে ঘোরেন। বলেন, খারাপ হৃৎপিণ্ডতে দূষণ ছড়ায় গবু (আমার ডাক নাম, গোবিন্দ থেকে গবু)। কি যে বলেন মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না। অবশ্য চুরমুর, মানে আমার বউ, গোবরডাঙার মেয়ে হলে কি হবে, মাথাটাতে একবিন্দু গোবর নেই... মিছিমিছি ঠাট্টা করলাম, দারুণ বুদ্ধি, ও মাঝে মাঝে কিছু কথার মানে বুঝিয়ে দেয় আমায়। এই তো সেদিন, বিলুবাবু বলল, 'গোবু সাঁতার দিস নি বেশি, ভাসতে শেখ। স্রোতের সাথে খেলতে শেখ। ইচ্ছা মানে বাসনা নয়। ইচ্ছা মানে খেলা। ইচ্ছায় মানুষ ভাসে, বাসনায় মানুষ সাঁতরায়।'
কথা হল, আমার জলে মৃত্যু খগেন জ্যোতিষী বলেছে। পাঁচশো এক টাকা দিয়ে কুষ্ঠী বানানো জানেন। সে খগেনের মেলা গল্প, এখন থাক। তো যেটা বলছিলাম, আমি কেন মিথ্যা মিথ্যা জলে নামব বলুন? আর জলে না নামলে সাঁতারই বা কাটব কি করে, আর ভাসবই বা কি করে? তাছাড়া ভেসে থাকাও তো একধরণের সাঁতার না কি? কিছু ভুল বললাম? অবশ্যি হতেও পারে, আমি জলের কিছু জানি না। চুরমুর জানে। ওদের গ্রামের বাড়িতে বিশাল পুকুর। আর বলবেন না, সেই পুকুরেই তো একবার ওর জ্যাঠতুতো দাদা... ছিঃ ছিঃ কি সব বলে ফেলছি আপনাকে। আপনি এসব কথা কিন্তু কখনও ওকে, মানে চুরমুরকে বলবেন না। ওই শুনুন আবার ডাকছেন, আসছি।"
"উফ্ কি ঝঞ্ঝাট। উনি বললেন, আপনাকে আর কুড়ি মিনিট পর ভিতরে যেতে। কি আশ্চর্য উনি এই অ্যাতোগুলো বছরে প্রথম কারোর সাথে দেখা করতে চাইলেন। সে যাক! আপনি কিন্তু অবশ্যই যাবেন, কথায় কথায় খেয়াল থাকে না আমার।
আচ্ছা, আপনি ওর কে হন? মানে দেখা করতে চাইছেন কেন? কি করে খোঁজ পেলেন? আগে থেকে চিনতেন? বয়েস দেখে তো মনে হচ্ছে ওনার ছাত্র ছিলেন, তাই কি?
হাসছেন যে! আচ্ছা বেশ, বলতে হবে না। কি বললেন? ক্যান নট স্পিক বেঙ্গলী? ও! আপনি বিদেশি? না? তবে? ওদের দেশে জন্ম? ও। বুঝতে পারেন? কি আশ্চর্য! মাদারটাঙ তামিল? ও বিদেশি না তবে... কিছুই তো বুঝছি না মশায়। দেখে তো ভূত বলে মনে হচ্ছে না। আচ্ছা বলুন তো রাম। আহা এই তো... বলুন তো যীশু... আহা এই তো... বলুন তো মুহম্মদ... এও তো বলে দিলেন... বলুন তো লেনিন... তাও বললেন... ও ভিতরে যাবেন... আচ্ছা যান... আসুন।"
এরপরের ঘটনাটা আমি, মানে লেখক, শুনেছি বহুদিন পরে আমাদের গোবুর মুখেই। সে নাকি সেই আগন্তুক ভদ্রলোককে ঘরে ঢুকিয়ে তো বাইরে অপেক্ষা করছে। এদিকে ওরা আর বেরোয় না। ওদিকে লাইব্রেরীতে মানুষ ঢোকার সময় হয়ে যাচ্ছে। তখন অগত্যা সে ঘরে ঢুকে পড়ে। ঢুকে তো তার চক্ষু ছানাবড়া! সেই আগন্তুক ঘাড় মটকে পড়ে। পাশে ক্রুদ্ধমূর্তি বিলুবাবু। ঘটনাটা হল এই, এই লোকটা যখন ছেলে ছিল, সে বিলুবাবুর ছাত্র ছিল। সেই নাকি রটিয়ে বেড়ায় বিলুবাবুর সাথে দত্তবাড়ির মেয়ের প্রেম ছিল, সেই থেকে ওই মেয়েটার উপর ওর বর সন্দেহ করে আর অত্যাচার বেড়ে যায়। মেয়েটা আত্মহত্যা করে। সেই শোকে বিলুবাবু।
কিন্তু একটা কথা এখনও বোঝেনি গোবিন্দ, কেন অ্যাদ্দিন দেরি করলেন বিলুবাবু। এটা নিয়ে অনেক ভেবেছে গোবু। কিন্তু বিলুবাবু সেই যে সেদিন চলে গেলেন আর এই পঞ্চানন লাইব্রেরীতে আসেন নি। ফলে জানাও যায় নি। চুরমুর সে রহস্য ভেদ করল অবশেষে। দত্তবাড়ির মেয়েটার বর যদ্দিন বেঁচে ছিল তদ্দিন বিলুবাবু ওর গায়ে হাত দেননি, কারণ ওই লোকটা নাকি দত্তবাড়ির মেয়েটার বড় ননদের ছেলে ছিল, (সে ননদ তামিল একজন ডাক্তারকে বিয়ে করেছিল।) লোকটার অপঘাতে মৃত্যু হলে সন্দেহ আরো বাড়ত না! তাই অদ্দিন অপেক্ষা।
(ছবিঃ সুমন)