সৌরভ ভট্টাচার্য
25 August 2019
মাঝরাতে গায়ে খসখসে কি লাগছে? মশারিটা। মাথার ডানদিকের দড়িটা খুলে গেছে। লোকটা উঠল। দড়িটা লাগাতে লাগাতে মনে পড়ল, আজ তো সে মশারি টাঙিয়েই শোয়নি। তবে?
খুক খুক করে কাশি, ঘরের মধ্যে। একটা খ্যানখেনে আওয়াজ, "আমি লাগিয়েছি রে হতভাগা, নকুড়দা, গেলবার নবমীর দিনে ডেঙ্গু হয়ে মরলাম না!"
লজ্জা পেয়ে মাধব দত্ত বলল, "আপনি আবার কষ্ট করতে গেলেন কেন? মিছিমিছি আপনাকে আবার..."
নকুড় বলল, "না রে, দেখলাম তুই খালি গায়ে বিনা মশারিতে শুয়ে... তোর তো আবার আমার মত বউ নেই যে... সে যাক... আমার বউটা খগেনের মুদির দোকানে দু'বেলা যাচ্ছে, দেকেচিস..."
মাধব বিছানায় ঢুকে চিৎ হয়ে শুল, বলল, "হুম, ও খগেন জন্মের থেকেই লুজ ক্যারেক্টর..."
- হুম, ওর মশারিটা খুলে দিয়ে এলাম, দেখি যদি মা দয়া করে এদিকে পাঠিয়ে দেন...
মাধব আবার লজ্জা পেল, বলল, "আমরা থাকতে তুমি একটা মশার উপর নির্ভর করবে দাদা, ভুলে গেলে নাকি যৌবনে তুমি আমি কত মাথা ধড় থেকে নামিয়েছি!"
- আরে ধুর, সে তো পাঁঠার মাথা শালা...
- ও খগেন দাদা পাঁঠারও অধম, শালা কণ্ডোমও বেচে দু'নম্বরি, তোমার মনে নেই জ্যোতির তৃতীয় ছেলেটা তো ওই দু'নম্বরি কন্ডোমের জন্যেই হয়ে গেল... শালা লিক করে আগে দেখেও নেয়নি...
- হুম, তাই তো পাড়ায় ওকে লিক বলে ডাকে... বড় সুন্দর বাঁশি বাজায় রে...
- হুম দাদা।
দু'জনেই চুপ।
মাধবের একটু লজ্জা লজ্জা এখনও লাগছে। সে আবার কথা শুরু করল, "দাদা একটু ঘুমোবে না?"
নকুড় বলল, "না রে। শুতে গিয়েছিলাম তোর বউদির পাশে, খগেনের নাক ডাকায় চলে এলাম।"
মাধব জিভ কাটল।
মানুষ হলে চোখে পড়ত না, অন্ধকার ঘর তো। নকুড় বলল, "তা আর জিভ কেটে কি হবে ভাই..."
মাধব বলল, "দাদা এটা কি সত্যি তোমাদের নাকি ওই নাম শুনলে থাকা দায় ঘরে..."
- কি নাম রে?
- ওই যে দাদা, রামানন্দ সাগর যেটা নিয়ে সিরিয়াল করত...
- ও রামায়ণের কথা বলছিস? মানে রামনাম? ওসব আগে হত, এখন আর হয় না, এখন তো আমরাও করি, ওতে সুবিধা অনেক।
মাধবের চোখ জুড়িয়ে আসছে, কিন্তু কৃতজ্ঞতায় ঘুমাতে পারছে না। পাড়ার অমন ডাকসাইটে নেতা তার ঘরে মশারি টাঙিয়ে দিতে এল, আর সে ঘুমাবে!
- দাদা শুনেছ, আমাজনে আগুন লেগেছে!
- তাতে আমার বাবার কি রে, আমাদের অক্সিজেন লাগে না। তবে জঙ্গলটা শেষ হল, এটা দুঃখের। অনেক বিদেশীরা আমার মত অবস্থায় ওখানে শেল্টার নেয় রে, নিরিবিলি জায়গা তো....
- আচ্ছা দাদা রবীন্দ্রনাথ কোনোদিন আমাজনের জঙ্গলে গেছে?
- হঠাৎ?
- এমনি। আপনি তো খুব রবীন্দ্রনাথ পড়তেন তাই।
- না মনে হয়।
- শান্তিনিকেতন ওখানে গড়লে কত ভালো হত না?
- ধুর পাগল, কে পড়তে যেত?
- কেউ যেত না। তবু শান্তিনিকেতন তো থাকত।
- বুঝেছি, তুই শোয়ার আগে আবার পাঁচুর ঠেকে গিয়ে গিলে এসেছিস না?
- হুম দাদা, মিথ্যা বলব না। তুমিও তো যেতে বলো?
- তা যেতাম।
- আচ্ছা দাদা, আমাকে নিয়ে তুমি হঠাৎ এত ভাবছ কেন? আমি তো তোমার বিরোধী দল করতাম।
- তা বটে। তবে কেন করছি ঠিক জানি না জানিস তো। আসলে মানুষের উপর বিশ্বাসটা চলে যেতে চাইলে নিজেকে অসহায় লাগে। তা ছাড়া...
- কি দাদা?
- আমার মনে হল, তুই হয়ত আমায় এখনো ক্ষমা করতে পারিস নি...
- কেন দাদা?
- নবকে তোর সাথে বিয়ে না দিয়ে ভাইয়ের সাথে...
- সে জানি দাদা, নব'র বাবার প্রচুর সম্পত্তি, আর তোমার অত ক্ষমতা, আমার সে কাঁচা বয়েসের পাগলামী ছিল... তা কি হয়...
- তবু, আমার ভাইটাও তো সুখী হল না... বাচ্চাকাচ্চা হল না....
- হুম। সে যার যা কপাল বলো, তোমারও তো হল না বলো...
- সেই... তুই যদি একটু বুঝিয়ে তোর বউদিকে বলিস...
- কি দাদা?
- ও যেন খগেনকে বিয়ে করে, নইলে বংশটা আমাদের আর থাকবে না রে...
নকুড় হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
মাধব অনুভব করল তার খালি গায়ে জলের ছিটে আসছে... লুঙ্গিটাও ভিজে যাচ্ছে..
সে ধড়ফড় করে উঠে বলল, "এই কথা আমি বৌদিকে বলব... আমার মাথাটা থাকবে ধড়ে!"
- আহা, তুই বলবি কেন? নব যখন তোর সাথে দেখা করতে আসে, তখন ওকে বলবি, ও গিয়ে বোঝাবেখন...
মাধব ঘামছে। ঝিঁঝি ডাকছে।
- আর শোন, তুই আগের দিন নবকে যে আইপিল খাইয়েছিস, ওটা আইপিল না রে, আমি হজমের ওষুধ রেখে দিয়েছিলাম... তুই আর বাধা দিস না মাধব, আমার বংশপ্রদীপ চাই... যে পথেই আসুক... বীজ মাটির জাত হয় না রে... চারাগাছ চারাগাছই হয়...
এতবড় দর্শন মাধব হজম করতে পারল না। মাধবের দোকানের পাঁঠাগুলো অনাথ হল, মাধব নিরুদ্দেশ। লোকে বলে মৌনিবাবা হয়ে কার্শিয়াং-এ আছে।
ওদিকে নব'র ছেলে হয়েছে, লোকে বলে কার সাথে যেন মিল। বুঝলেও বলতে পারে না। খগেন নকল ফাটা কন্ডোম বিক্রি করে অবাঞ্ছিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির দ্বারা জনহত্যার দায়ে জেলে, সাথে অবশ্য প্লাস্টিকের ডিম বিক্রি করে কিছু মানুষ মেরেছে বলে তার উকিল মামলাটা মিটিয়ে ফেলবে কথা দিয়েছে। জজ সাহেব নাকি রাতের বেলা ভুতের উপদ্রবে শুতে পারছেন না। কে নাকি শুলেই কানের কাছে বলছে, "জেলে বীজ পচাস না বাবা... বীজের কোনো জাত হয় না...."