এ আমার একার অস্তিত্ব। অল্প অল্প ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মত। আকাশ ধরো সময়। ধরো সব মেঘ বিছিয়ে দিলেও আকাশ শূন্য থেকে যাবে। আমি সব সময় একা। এত মানুষ এলো গেলো। এত ভালোবাসা-বাসি। এত বুকফাটা বিরহ। এ সবই হল। কিন্তু দাগ কাটল না। আমি একা। এটাই আমার পরিচয়।
মন তো অজ্ঞান। পশুপাখির মত অজ্ঞান। বুদ্ধি একা একা জগত ঘাঁটে, জ্ঞান কুড়ায়। মনের তাতে কি? মন খোঁজে সুখ। বুদ্ধি খোঁজে জ্ঞান। আমি কি খুঁজি? ভালোবাসা।
এই যে সামনে নদীটা, ওপারে বোধহয় চন্দননগর, এরা কেউ আমার কিছু নয়। জীবন মানে একটা ট্রেলার। আসল জীবনটা যেন কেউ দেখছে না, সবাই ট্রেলার দেখছে, ভাবছে এইটাই আসল। আসলে কি তাই?
আজ আমার কোথাও যাওয়ার নেই। ভাটপাড়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জে এসেছি বাড়ির ল্যাণ্ডলাইনটা সারেণ্ডার করে দিতে। মোবাইলের যুগে কে এসব ঝক্কি সামলায়? অর্ধেক দিন তাও লাইনই থাকে না। বাল!
বাবা মদ খায়। বাবা মিলে কাজ করে। বাবা মেয়েবাজী করে। মা খেটে মরে। বোনকে খারাপ রাস্তায় যেতে আটকাতে থাকে। আমাকে ভালো চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলে।
মানুষ সব মন দিয়ে বাঁচে না। একটা মন সবসময় অন্যমনস্ক থাকে। একলা মন সে। কারোর কিছুতে তার যায় আসে না কিছুই। এমনকি যার মাথা-বুক অধিকার করে শিকড় গজিয়ে আছে তাকেও সে ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না। এই মনে যার টান লেগেছে তার ঘরে থাকা দায়। আমার এই মনে টান লেগেছে। মাঝে মাঝেই বুকে হ্যাঁচকা টান। বিধ্বস্ত লড়াই। একতারার বোল। হরিবোল হরিবোল। আমি বাউল হব।
আবার নাও হতে পারি। হতে পারি আমি হয় তো ভীষণ কামুক। মানুষের মনের একটা ওদিক থাকে। ঠিক এদিকের বিপরীত। মনের ভিতর চোরাবালি। চোরাটান। কোথায় নিয়ে যায় কেউ জানে না। নগ্ন শরীরের নেশা। সেও আছে। পাগল করা নেশা। সেও হয়। অবিদ্যা মায়া। অন্ধকূপ। সেও আছে। সুখ। ধোঁয়া ধোঁয়া সুখ। আলো আলো সুখ জাগে চিত্তে। ধোঁয়া ধোঁয়া সুখ জাগে শরীরের সঙ্গে শরীরের ঘর্ষণে। সেও আছে। ঈশ্বর নগ্ন হয়। ঈশ্বর ভালোবাসা হয়। ঈশ্বর কাম হয় না কেন? কামের পরে জাগে বিষাদ। অবসন্ন। নীড় ছাড়া পাখি। যেন এইমাত্র ঝড়ে উড়ে গেল। একটু আগেও ছিল নীলাকাশ। শরীরের সঙ্গে শরীরের ঘর্ষণে জাগে অবয়ব, নিঃসঙ্গ বিমূর্ত অবয়ব। কুয়াশার মধ্যে ডাকে। হঠাৎ কুয়াশা যায় মিলিয়ে। যেন সারারাত ছটপটিয়ে এলো ঘুম শেষরাতে, হঠাৎ কেউ দিল পর্দা সরিয়ে। দিনের চড়া আলো এসে পড়ল মুখের উপর চড়ের মত।
সবার জীবনে একজন উপগুপ্তকে দরকার। সংসার সীমানার বাইরে ফেলে এলে কে নেবে বুকে? কে শোনাবে ধর্মের কথা? অনন্ত আশার কথা? অনন্ত ভালোবাসার কথা? যে ভালোবাসা করুণার মত ক্ষমাশীল। মানুষ ক্ষমা চাইবে। মানুষের পাপ যেমন অবশ্যম্ভাবী, ক্ষমাও তেমন। শুধু মুখ ফেরানোর অপেক্ষা। অপেক্ষা মানে সময়ের নূপুর। যদি কানে শোনো তুমি মুক্ত।
আমার কাজ শেষ। এইটা সরকারি অফিস। বিএসএনএল। কেউ সে লাইন ব্যবহার করে না। সবাই বলে ভোডাফোন, এয়ারটেল ভালো। কল করলে পাওয়া যায়। যে মানুষটা আমার সঙ্গে কথা বলে গেল, সে একজন অফিসার। নতুন জয়েন করেছে। মা আমাকে এখানে দেখতে চায়। সরকারি অফিসে। আমার মদ্যপ বাবাও। বোন চায় না। বোন চায় আমি বাউল হই। আমায় ওই বেশেই মানায় ভালো। বোন বলে। বোন নাকি আমায় স্বপ্নে দেখেছে। আমিও স্বপ্ন দেখি। অশ্লীল স্বপ্ন। বিছানা ভেজানো স্বপ্ন। ঘুমন্ত শরীরও কাম বোঝে। শরীর তুমি ঈশ্বরকে চাও না কেন? এত বাস্তব কেন তুমি? শরীর তোমার মানুষ হতে ইচ্ছা করে না? শরীর তোমার যৌনতার সমস্ত গুহাসুখ ছেড়ে আলোর সমুদ্রে নামতে ইচ্ছা করে না?
এরা সুখী নয়। এরা কৃতি। এরা মোটা মাইনে নিয়ে বাড়ি যাবে। এদের সব সুখ সমান্তরালে চলে। এদের অর্গাজম হয় না। এদের খিদে মেটে। অর্গাজম হয় ঝুঁকিতে বাঁচা মানুষের। এসপ্ল্যানেডে বাস খাদে পড়ে না। সেখানে বাসে বাসে ঠোকাঠুকি হয় বড়জোর। সেখানে বাসের তলায় চাপা পড়ে মানুষ। পাহাড়ে মানুষ বাসের তলায় চাপা পড়ে না। খাদে পড়ে যায় কেউ কেউ।
এখন আমি কাঁকিনাড়া স্টেশানে। আমার সদ্য ব্রেক আপ হল কাল। এখন আমার বুকে কামের তোড়। নিজেকে জাগিয়ে রাখার জন্য। সেক্স একটা পজিটিভ ড্রাইভ। যারা আত্মহত্যা করে তাদের নিশ্চয়ই সেক্স ড্রাইভ কম। সেক্স নিজেকে সৃষ্টি করে প্রতি মুহূর্তে। কল্পনায়। সেক্স না হলে কল্পনা পূর্ণতা পায় না। আমার মনে হয়। পবিত্রতা মানে সেক্সের উপর জয়। মানে সেখানেও সেক্স আছে, ইন্যাক্টিভ, বাট উইথ ফুল পোটেনশিয়ালিটি।
আমার ব্রেক আপ হল। আমি অসাড় থাকব এখন ক'দিন। খুব অপেক্ষা করব আবার ফিরে আসুক সে। আবার তার নগ্নতাকে জয় করি নিজের নগ্নতার উল্লাসে। উল্লাস। কত বিশ্রী শব্দ। মানুষ নিজের পার্ভার্টনেসকে জানে। সবাই জানে। নইলে অন্যের পার্ভার্টনেস নিয়ে এত মাথা ঘামাতো না। কেউ পার্ভার্ট হলে মানুষ তাকে হিংসা করে। সব মানুষ করে। তারিয়ে তারিয়ে তার পার্ভার্টনেসকে নিজের লালসায় চেখে দেখে মনে মনে। তারপর গ্যাস বেলুনের মত আকাশে উড়িয়ে বলে, যা, উড়ে যা। আমি ভদ্র হই। সবই সময়ের খেলা। সিগারেটের সাইজ এক, খাওয়ার সময় আলাদা আলাদা ভোক্তা অনুযায়ী।
জীবনটাকে ছিবড়ে কোরো না মাল। চোষো, কিন্তু ছিবড়ে করে ফেলো না। এই তো তত্ত্ব। ট্রেন এসেছে। আমার সামনে চারটে হিজড়ে। হিজড়েদের মত বাউল আমি কম দেখেছি। মানে বাউলমনা। কাউকে পাত্তা দেয় না। এত আত্মবিশ্বাস আসে কোত্থেকে? ওই যে রবীন্দ্রনাথ --- অপমানে যার সাজায় চিতা সে যে বাহির হয়ে এলো অগ্নিজিতা।
হিজড়ে মানেই অগ্নিজিতা। মান অপমান তুচ্ছ করেছে। কারণ তার যৌনাঙ্গ আলাদা। হায় রে সভ্যতা। হায় রে বুদ্ধিজীবী মানুষ। যৌনাঙ্গের আকারে মানুষ ভিন্ন হয়ে গেল। তার মান ইজ্জত খেলার জিনিস হয়ে গেল। সমাজ মানে পুরুষাঙ্গ। উপসমাজ, মানে পুরুষাঙ্গের নীচে যোনি। তার আশপাশে ছড়িয়ে আগাছা --- ভুল জননাঙ্গ --- তোমরা, হিজড়ে।
হিজড়েদের চোখের দিকে তাকালে কষ্ট হয়। একটা দম চাপা কষ্ট। একটা মানুষী কষ্ট। মাকে বাবার মার সহ্য করার পর, উনুনে আঁচ দিতে দিতে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি।
আমি নামব শ্যামনগরে। জগদ্দল চলে গেল। হিজড়েরা নেমে গেল। ওরা বড্ড জোরে জোরে হাসে। বড্ড জোরে জোরে কথা বলে। ওরা জোরে জোরে তালি দেয়। ওরা সংসারকে উপেক্ষা করে। পুরুষাঙ্গ, যোনি সব কিছুকে উপেক্ষা করে।
শ্যামনগর। এই নামলাম। আমি বাড়ি যাচ্ছি। আমার মন বিষণ্ণ হয়ে গেল। আমার আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। গিয়ে সেই এক ছবি। মদের গন্ধ। মায়ের উসকোখুসকো মুখ। বোনের শরীর চর্চা। ওর বুদ্ধি নেই কল্পনা চাওলার মত। ওর পড়াশোনা হবে না। আমাদের বাড়ির পরিবেশে কারোর পড়াশোনা হবে না। ও নিজের বুকটা মাপে। রোজ মাপে। একদিন রাজপুত্র আসবে। ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ওর শরীরে কামের খিদে নেই। ওর শরীরে কামের ফাঁদ। রোজ অল্প অল্প করে বুনছে। আমার পাপী মন। সে ফাঁদের আশেপাশে ঘুর ঘুর করেছে। পা দেয়নি। মন বাউল হ। মন বাউল হ।
সাইকেলটা দাদুর। মারা যাওয়ার আগে আমায় দিয়ে গেল। মানুষ মারা যাওয়ার আগে গোটা জীবনটা পারলে কাউকে দিয়ে যায়। এত অপচয়। এত খামতি। একা সব দায় নেওয়া যায়? সাইকেলের পিছনের চাকায় পাম্প নেই। টানতে হচ্ছে। নাকি মন বিষণ্ণতায় নেতিয়ে আছে?
আর কথা বলব না। আমার ফোন বাজছে। মা। খাওয়ার সময় হল। মা ডাকছে। কদ্দিন ডাকবে? মার খেতে খেতে একদিন তো মরেই যাবে। আমি বাউল হব সেদিন। ঈশ্বরের বুকের উপর দাঁড়িয়ে বলব, খা আমায়। ঈশ্বর শিকারকে দৌড় করিয়ে খায়। আমি নিজে ধরা দেব। ঈশ্বরের পৌরুষে লাগবে। আমি বাউল হব। ঈশ্বরের পৌরুষে আঘাত করে বলব, লে লে, গেল আমায় গেল।