আমাদের উচ্চ-মাধ্যমিক সিলেবাসে 'লোকহিত' বলে একটি প্রবন্ধ ছিল। প্রবন্ধটা গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল সেই সময়ে। আজ জট ছাড়িয়ে দেয় অনেক সমস্যার।
প্রবন্ধটা 'সবুজ পত্র' তে ১৩২১ সালে ভাদ্র মাসে ছাপা হয়। পরে 'কালান্তর' প্রবন্ধসংগ্রহে যোগ হয়।
এটা বাংলা ১৪২৪ সাল। তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে মনে একটুও সন্দিহানরেখা জন্মালো না আজও, ১০৩ বছর পরেও। মিথ্যার আড়ম্বর, প্রাবল্য, লোকবল, ধনবল আর যাই থাক, তার একটি জিনিস নাই বলেই সে চিরটাকাল মিথ্যা, তা হল সত্যবল।
মানুষের সব চাইতে সঙ্কটজনক নিঃসঙ্গতা বোধহয় বৌদ্ধিক নিঃসঙ্গতা। আজ আশেপাশে ফের এমন এমন আলোচনা, সমস্যা মাথা চাড়া দিচ্ছে যে এই লেখাগুলোর ঔজ্জ্বল্য আরো বেশি করে চোখে পড়ছে। সেই প্রবন্ধের কয়েকটা নির্বাচিত, আমার পথপ্রদর্শক পঙক্তি তুলে দিলাম।
"মানুষ কোনোদিন কোনো যথার্থ হিতকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করিবে না, ঋণরূপেও না, কেবলমাত্র প্রাপ্য বলিয়াই গ্রহণ করিতে পারিবে।
হিত করিবার একটিমাত্র ঈশ্বরদত্ত অধিকার আছে, সেটি প্রীতি। প্রীতির দানে কোনো অপমান নাই কিন্তু হিতৈষিতার দানে মানুষ অপমানিত হয়। মানুষকে সকলের চেয়ে নত করিবার উপায় তাহার হিত করা অথচ তাহাকে প্রীতি না-করা।"
উপরের উদ্ধৃতিটির যে লাইনটা সেদিন সবচেয়ে ভালো লেগেছিল, "মানুষকে সকলের চেয়ে নত করিবার উপায় তাহার হিত করা অথচ তাহাকে প্রীতি না-করা।"
এটা খুব গভীরে ধাক্কা লেগেছিল সেদিন। মনে হয়েছিল, জীবে শিব দেখে সেবার চাইতে এই কথাগুলো যেন সহজে বুঝলাম। জোর করে কোনো ভাব আরোপ করে কোনো কাজ করলে তা বেশিদিন টেকে কি? তার মধ্যে অনেক ফাঁকি জমতে শুরু হয় যে!
পরের উদ্ধৃতি,
"আমাদের ভদ্রসমাজ আরামে আছে কেননা আমাদের লোকসাধারণ নিজেকে বোঝে নাই। এইজন্যই জমিদার তাহাদিগকে মারিতেছে, মহাজন তাহাদিগকে ধরিতেছে, মনিব তাহাদিগকে গালি দিতেছে, পুলিস তাহাদিগকে শুষিতেছে, গুরুঠাকুর তাহাদের মাথায় হাত বুলাইতেছে, মোক্তার তাহাদের গাঁট কাটিতেছে, আর তাহারা কেবল সেই অদৃষ্টের নামে নালিশ করিতেছে যাহার নামে সমন-জারি করিবার জো নাই। আমরা বড়োজোর ধর্মের দোহাই দিয়া জমিদারকে বলি, তোমার কর্তব্য করো, মহাজনকে বলি, তোমার সুদ কমাও, পুলিসকে বলি, তুমি অন্যায় করিয়ো না-- এমন করিয়া নিতান্ত দুর্বলভাবে কতদিন কতদিক ঠেকাইব। চালুনিতে করিয়া জল আনাইব আর বাহককে বলিব যতটা পারো তোমার হাত দিয়া ছিদ্র সামলাও-- সে হয় না; তাহাতে কোনো এক সময়ে এক মুহূর্তের কাজ চলে কিন্তু চিরকালের এ ব্যবস্থা নয়। সমাজে দয়ার চেয়ে দায়ের জোর বেশি।"
কালের মরচে লেগেছে কি? লাগেনি তো!
শেষ উদ্ধৃতি,
"লেখাপড়া শেখাই এই রাস্তা। যদি বলি জ্ঞানশিক্ষা, তাহা হইলে তর্ক উঠিবে, আমাদের চাষাভুষারা যাত্রার দল ও কথকঠাকুরের কৃপায় জ্ঞানশিক্ষায় সকল দেশের অগ্রগণ্য। যদি বলি উচ্চশিক্ষা, তাহা হইলে ভদ্রসমাজে খুব একটা উচ্চহাস্য উঠিবে-- সেটাও সহিতে পারিতাম যদি আশু এই প্রস্তাবটার কোনো উপযোগিতা থাকিত।
আমি কিন্তু সব-চেয়ে কম করিয়াই বলিতেছি, কেবলমাত্র লিখিতে পড়িতে শেখা। তাহা কিছু লাভ নহে তাহা কেবলমাত্র রাস্তা-- সেও পাড়াগাঁয়ের মেটে রাস্তা। আপাতত এই যথেষ্ট, কেননা এই রাস্তাটা না হইলেই মানুষ আপনার কোণে আপনি বদ্ধ হইয়া থাকে। তখন তাহাকে যাত্রা-কথকতার যোগে সাংখ্য যোগ বেদান্ত পুরাণ ইতিহাস সমস্তই শুনাইয়া যাইতে পার, তাহার আঙিনায় হরিনামসংকীর্তনেরও ধুম পড়িতে পারে কিন্তু এ-কথা তাহার স্পষ্ট বুঝিবার উপায় থাকে না যে, সে একা নহে, তাহার যোগ কেবলমাত্র অধ্যাত্মযোগ নহে, একটা বৃহৎলৌকিক যোগ।......
তাই আমি এই বলি, লিখিতে পড়িতে শিখিয়া মানুষ কী শিখিবে ও কতখানি শিখিবে সেটা পরের কথা, কিন্তু সে যে অন্যের কথা আপনি শুনিবে ও আপনার কথা অন্যকে শোনাইবে, এমনি করিয়া সে যে আপনার মধ্যে বৃহৎ মানুষকে ও বৃহৎ মানুষের মধ্যে আপনাকে পাইবে, তাহার চেতনার অধিকার যে চারিদিকে প্রশস্ত হইয়া যাইবে এইটেই গোড়াকার কথা।"
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বলেই কথাগুলো সত্যি তা নয় অবশ্যই। কিন্তু সত্যিটাকেই উনি বিনা মোড়কে বলেছেন বলেই তা সত্যি। কারণ সত্যের চেয়ে বড় কিছু বানাতে গেলে তা যতই যাই হোক না কেন, তা মিথ্যাই হয়। তাই শ্রদ্ধা আর ভক্তির আতিশয্যকে চিরকাল মানুষ একটু সন্দেহের চোখেই দেখে থাকে। আজ চারদিকে যার নিদর্শন ভুরি ভুরি বাড়ছে।