Skip to main content
 
 
       লালিগ্রামে ঝুলু আর লুলু পৌষ সংক্রান্তির দিন পঁচিশটা গরু কিনে আনল হাট থেকে। ঝুলুর চাষ গাজরের, লুলুর চাষ মূলোর। ঝুলুর গরুরা খায় গাজর, আর লুলুর গরুরা খায় মূলো। তা তাদের নাম হল গাজর-গরু আর মূলো-গরু।
       ঝুলুর আছে কুয়ো আর লুলুর আছে দীঘি। ঝুলুর গরুরা খায় কুয়ো তোলা জল। লুলুর গরুরা খায় দীঘি আনা জল। তা তাদের গ্রামের লোকে ডাকে কুয়োগরু আর দীঘিগরু।
       ওদিকে লালিগ্রামে পঁচিশ বছর আগে একবার দুশো ছাব্বিশটা বাঁদর এসেছিল। কি উৎপাত না কি উৎপাতটাই করেছিল! তখন ঝুলু-লুলু সদ্য জন্মেছে। গরু-বাঁদর আলাদা করতে পারে না, চোখই ফোটেনি যে। কিন্তু সে বছর এমন আমাশার উপদ্রব হয়েছিল গ্রামে যে গ্রাম উজাড় হওয়ার জোগাড়। লুলু-ঝুলু'র পরিবারের সব লোক তো হেগেই মরল গো। গ্রামে শেষে কিনা ছোঁচাবার জল বাড়ন্ত হয়েছিল! লোকে বলল, ওই বাঁদরের দলই এর মূল। তা কিন্তু না, এই গ্রামের লোকগুলো বড্ড নোংরা ছিল। শুদ্ধাচার বলতে কিছুই বুঝত না। তো আমাশার জীবাণু তো ছিলই এডালে সেডালে লুকিয়ে। বাঁদরে সেগুলোকে নাড়াচাড়া করে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়েছে তা অবিশ্যি সত্য কথা।
       তো সেই থেকে এই লালিগ্রামে বাঁদর এলেই সব লোক গাড়ু হাতে তৈরি থাকে। স্কুল ছুটি দেওয়া হয়। অফিস কাছারিতে অতিরিক্ত পঁচিশটা করে শৌচালয় বানানো হয়, পার্মানেন্ট নয় যদিও। নানা ব্রত উপবাস শুরু হয়। সারারাত দিন দূরের শহর থেকে ডাক্তারেরা বড় বড় তাঁবু খাটিয়ে বসে থাকে। কিন্তু সেইবারের মত অমন মহামারী আর দেখা যায়নি। কিন্তু এতবড় গ্রাম, কারোর না কারোর পেট খারাপ তো হবেই যে সময় বাঁদরের দল আসে। তাই লোকের এখনও বিশ্বাস বাঁদরের জন্যেই অমন হয়।
       এদিকে অ্যাদ্দিনে লুলু-ঝুলু অনেক বড়। তারাও বাঁদর এলে নিয়ম করে গাড়ু হাতে পায়খানায় যায় দিনে দু'বার। মাঝে গ্রামে হাগাবাবা এসেছিলেন। তিনি নাকি আজন্ম পায়খানা করেননি। সমস্ত মল যোগবলে তিনি আত্মস্থ করে নেন। তাই তাঁর সন্ন্যাস নাম মলানন্দ বাবা। তা তিনি কি করলেন একবার সব্বাইকে একটা করে তাবিজ আর দুটো করে পাতা দিয়ে বললেন রাতে পাতাদুটো চিবিয়ে সকালে উঠে তাবিজ পরে নিতে। সবার ঘুম ভাঙে তিনদিন পর। গ্রামের আঠারোটা মেয়েকে পাওয়া যায়নি তারপর থেকে আর। কেউ বলে তারা বাবার শিষ্যা হয়েছে, কেউ বলে দুষ্টুবাবাকে দুষ্টুমি করতে দেখেছে যাদের পাতা খেয়ে নেশা হতে দেরি হয়েছে। কিন্তু সব্বাই এখনও তাবিজটা বেঁধে রেখেছে হাতে। কি জানি কোথা থেকে কি হয়। ফি বছর আমাশার জীবাণু মারার ধোঁয়া দেওয়া হয় গ্রামে। লোকের সেটাতে অত বিশ্বাস নেই। কেউ কেউ বলে সেই ধোঁয়ায় তারা বন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে। তাই ধোঁয়া দিতে এলে গ্রামে কেউ দরজা খোলে না। এক হরেন মাষ্টার ছাড়া। কিন্তু তার কথা কেউ শোনে না। বলে, ধোঁয়া নিশ্চয় খারাপ, নইলে তাবিজের রঙ এমন ফিকে হয়ে যাচ্ছে কেন?
       এদিকে ঝুলু-লুলু'র গরুগুলো যে একই হাট থেকে একই দিনে কেনা লোকে ভুলে গেছে। তাদের একপক্ষকে ডাকে গাজর-কুয়ো-পুবো-বাঁশপল্লী জন্তু বলে, আর আরেকপক্ষকে ডাকে মূলো-দীঘি-পশ্চিমে-ঝাউপল্লী জন্তু বলে। ক'দিন আগে গ্রামে দুই জন্তুর দলের মধ্যে কি মারামারি লাগিয়ে দিয়েছিল গ্রামের কিছু দুষ্টু লোক। যতই হরেন মাষ্টার বলে, ওরে ওরা একই জাতের জন্তু, তা কে কার কথা শোনে? এদিকে গরুগুলো নিজেদের মধ্যে গুঁতিয়ে এর তার প্রাণ নিচ্ছে, আর ওদিকে বাঁদরের দলও এসে পড়েছে সেই সময়েই, তারাও হইহট্টগোল লাগিয়ে দিয়েছে। এ গাড়ু নিয়ে যায়, সে গাড়ু নিয়ে ফেরে, এ ওকে জিজ্ঞাসা করে, দাদা গরুতাণ্ডব ক'দ্দূর? ও তাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনার ক'বার হল?
       হরেন মাষ্টার আর লুলু-ঝুলু চুপ করে একটা বড় বটগাছে উঠে বসে আছে। লুলু বলল, দাদা আপনাদের কি হাগা চাপছে? ঝুলু বলল, না। হরেন মাষ্টার বলল, না। লুলু বলল, আমারও না।
       তারা গ্রামের বাইরে তাকালো। দূর দূর অনন্ত মাঠ। সকালের রোদে ঝলমল করছে চারদিক। তারা কদ্দিন গ্রাম ছেড়ে বাইরেই বেরোয়নি। গ্রামের লোকেরাও বেরোয়নি। গ্রামের মধ্যে একটা যেন গুমোট হাওয়া। লুলু ফুঁ দিল। বটের একটা পাতা নড়ল। হরেন মাষ্টার ফুঁ দিল। বটের তিনটে পাতা নড়ল। ঝুলু ফুঁ দিল। সব্বাই ফুঁ দিতে শুরু করল। বটের কয়েকটা পাতা ঝনঝন করে কেঁপে নড়ে উঠল। কদ্দিন পাতাগুলো নড়েনি। পাতার গোড়ায় ধুলো জমে গেছে। কিন্তু কয়েকটা পাতা নড়তেই গ্রামের বাইরের হাওয়া এসে বটের সামনে দাঁড়াল। আর কয়েকটা পাতা নড়লেই তারা ঝড় তুলবে। গ্রামের গুমোটভাব কাটাবে। লুলু-ঝুলু আর হরেন মাষ্টার উদগ্রীব হয়ে নীচে তাকিয়ে, কয়েকটা জোয়ান মদ্দ যদি আসত... ফুঁ দিত একটা... জোরসে...