লালি ঘোষ, শান্ত মানুষ। রাতে ঘুম আসছে না বলে রাস্তায় পায়চারি করতে করতে পার্কের বেঞ্চে এসে বসেছে। নতুন কথা কিছু না, রোজই বসে। আজ বসেছে কারণ প্রচণ্ড পেট জ্বালা করছে। পাঁঠা হজম হচ্ছে না। কিন্তু পেট আর মনের দ্বন্দ্বে মনই জিতে যায়। সামলানো যায় না।
সিগারেটের অর্ধেক শেষ হয়ে এসেছে। হঠাৎ কেউ একজন বলল, একটু দুলিয়ে দেবেন?
লালি ঘোষ চমকে এদিক ওদিকে তাকালো। কেউ কোত্থাও নেই! সামনের দোলনাটা অল্প অল্প দুলছে। আওয়াজটা ওদিক থেকেই আসছে মনে হল। লালি ঘোষ ভুরুটা কুঁচকে একটু ভালো করে তাকাতেই দোলনার ওদিক থেকে কেউ বলল, আসুন না, ঠিকই ভাবছেন, আমি দোলনাতেই।
লালি ঘোষের সন্দেহ হল, এত গ্যাস হয়ে গেছে? একি! মারা যাবে নাকি সে এখন!
আহা, কি ভাবছেন মশায়... আসুন না... একটু দুলিয়ে দিন না….
মানে কি? লালি ঘোষের মেজাজটা বিগড়ে গেল, আপনি কি হেঁয়ালি করছেন… দেখা যাচ্ছে না কেন?
দেখাবার মত যা ছিল সে তো পুড়ে ছাই দাদা, আর নাভিকুণ্ডলী দেখে কি আমায় চিনবেন? তাও শালা আমার বড়ছেলে আহাম্মকের ঢেঁকি আমার নাভি না কুড়িয়ে আমার আগে পুড়ল নেতাইয়ের ঠাকুমা, ওর নাভি মন্ত্রটন্ত্র পড়ে ভাসিয়ে এলো জলে... আকণ্ঠ গিলে ছিল তো…..
লালি ঘোষ বলল, তা দোলার শখ হল কেন এই মাঝরাতে?
ধুর মশায়, শখের আবার দিন রাত। আসুন না... অল্প একটু….
অগত্যা লালি ঘোষ লুঙ্গিটা টাইট করে বেঁধে ভূত দোলাতে গেল। অল্প দুলিয়ে বলল, আরো জোরে দেব...?
থাক... এইতেই হবে... যান বসুন…. ডান দিক পাছা উঁচু করে বসে আছেন, মানে অর্শ…. রক্ত পড়ে…
ব্যথা হচ্ছে… কাল পড়বে…. আজ পাঁঠা মারলাম যে….
বুঝেছি... ও আমারও ছিল…. মরলাম... সব পুড়ল... সাথে আমার অর্শ নিয়ে পোঁদও পুড়ল... বাঁচলাম….
অশালীন শব্দ বলবেন না….
বেশ বলব না।
লালি ঘোষ চিন্তায় ডুবে গেলেন। সামনে জলজ্যান্ত একটা ভূত দোল খাচ্ছে, সে নিয়েই যেন কোনো ভাবনা। আসলে লালি ঘোষের বাড়িতে ভীষণ অশান্তি। লালি ঘোষের বউয়ের সঙ্গে মিন্টুর দোকানে কাজ করে যে ছেলেটা, নাম পাপন, তার একটা কিছু চলছে। ব্যাপারটা সবাই জানে এখন। এমনকি বোঁদেও স্বীকার করে নিয়েছে। বোঁদে লালির বউয়ের ভালো নাম, ডাক নাম দুই। লালির স্কুটারের গায়ে কে এক দুষ্টু ছেলে লিখে গিয়েছিল, লালির বোঁদে খেয়ে গেল কোন বেড়াল? পাপন বেড়াল, পাপন বেড়াল।
কি বোঁদেতে মাছি বসছে?....
লালি ঘোষ বিরক্ত হয়ে বলল, কাটা ঘায়ে নুনের ছেটা দিচ্ছেন?
আহা তা কেন? মানে বলছিলাম আর কি ছেড়ে দিন বুঝলেন….
আর নিজে গলায় দড়ি দিই নাকি?
দিতে পারেন। লাইনেও গলা দিতে পারেন, লকডাউন তো উঠে গেছে।
ঠাট্টা করছেন?
করছি। জীবনে আর কি করব বলুন? থুড়ি, মরণে। আপনিও তাই করুন। ভূত বলুন, মানুষ বলুন, না হাসলে বাঁচা যায়?
বউ পালাচ্ছে আর আমি দাঁত কেলিয়ে হাসব?....
হাসবেন। কেঁদে কি লাভ আছে…. সংসার মানেই অর্শ…. ব্যথা কম আর বেশি…. যাবে না বুঝলেন….
বিয়ে করেছিলেন…
বাব্বা, করিনি আবার! আজ ওর অন্তিম দিন, তাই তো নিতে এসেছি…. মাগীর শ্বাস উঠেছে সবে…. এলো বলে….
আপনি বড় বাজে শব্দ ব্যবহার করেন… তবু ভালোবাসা তো পেয়েছেন জীবনে….
তা পেয়েছি... আসলে ওকে ছেড়ে আমার বৈকুণ্ঠেও সুখ নেই বুঝলেন…
আমার ভাগ্য ভাবুন….
ভাবার কিছু নেই ভাই…. আরেকবার দুলিয়ে দেবেন প্লিজ….
লালি ঘোষ দুলিয়ে দিয়ে পাশের দোলনায় বসে নিজেই দোল খেতে লাগল।
তার চাইতে আত্মহত্যার রাস্তাটাই ভালো বুঝলেন, লালি ঘোষ বেশ স্থির কণ্ঠে বলল।
পাশের দোলনা থেকে উত্তর এলো, তবে চলুন, একটা মালগাড়ি আছে একটু পর... ওইতেই কেস রফা হয়ে যাক…. কি বলেন….?
এরপর দুটো দোলনা থেমে গেল। তারা দু'জন রেললাইনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। লালি ঘোষ যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করল, আপনার নাম কি?
হারাধন পাল। আমি কম্পাউণ্ডার ছিলাম রতন ডাক্তারের।
লালি ঘোষ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। রতন ঘোষ... মানে তো তার বাবা…. সেকি! এ সেই হারাধন জেঠু….
হারাধন বলল, চিনতে পারিসনি কুঁচু... যা হোক... শোন…. এই আত্মহত্যার চক্কোর রাখ…. বোঁদে এতক্ষণে পালিয়ে গেছে পাপনের সঙ্গে…. আমি লাস্ট ট্রেনে ওকে উঠতে দেখেই তোর কাছে এলাম….
লালি ঘোষ রাস্তায় বসে পড়ল। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বোঁদে... ও বোঁদে... বোঁদে গো…..
আশেপাশের কয়েকটা কুকুরও হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। ইতিমধ্যে লাউডগাদেবীও চলে এসেছে, মানে হারাধনের স্ত্রী। সে সবটা দেখে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। তারপর সবটা সামলিয়ে বলল, ও লালি… লালি রে... শোন... যা বাবা... ঘরে যা... হিম পড়ছে বাবা…. এরমধ্যে এত কান্নাকাটি করলে সর্দি লেগে একশা হবেনে…. চ বাবা... এই শোনো, আমরা একমাস লালির সঙ্গে থেকে যাই…. ঘরে ও একা একা কি করে থাকবে বলো?…. ঘরে অন্তত মানুষ তো...
তাড়াতাড়ি হারাধন বলে উঠল, তা আমরাই কি আর মানুষ আছি গো…?
লাউডগাদেবী বলল, বেশ, তবু আমরাই থাকব।
এরপর আর কি হবে? লালি এক হপ্তা বিছানা নিল। সপ্তাহ তিনেকের মাথায় বোঁদে ফিরে এলো, পাপনের নাকি এমন চুলকানি রোগ যে বোঁদের সারা গায়ে পান্তুয়ার মত চাকাচাকা দাগ পড়ে গেছে। ওর সঙ্গে ঘর করা যায়?
তবে ঘরে ফিরে এসে এমন ভরা সংসার দেখে বোঁদে তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল। হারাধন আর লাউডগাদেবীর এমন সেবা করল যে তারাও পাকাপাকিভাবে তাদের বাড়ি থেকে গেল।
আমার গল্পটি ফুরালো, নটেগাছটি মুড়ালো…. বাকিটা লাউডগাদেবীর কাছে রাতে শুনে নেবেন।
[ছবি Suman Das]