একটা পাখি ডেকেই যাচ্ছে। এইমাত্র মেঘ কেটে চাঁদ উঠল। আজ সারারাত লক্ষ্মী হেঁটে হেঁটে ঘুরবে। দেখবে কে কে জেগে আছে রাতে।
ট্রেন থেকে নামতেই পায়ের তলাটা টাটিয়ে উঠল। ধূপকাঠির প্যাকেটগুলো থেকে মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে। আজ ট্রেন অনেক লেট করল। নইলে এতক্ষণ লাগে?
ফাঁকা রাস্তা। সদ্য পঞ্চান্ন পেরোনো মানুষটা একা একা হাঁটছে। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ ভর্তি ধূপকাঠি। কিছু বিক্রি হয়েছে, কিছু হয়নি।
ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে সেই রাস্তায় এসে পড়ল। আঁচলে ঘামে ভেজা মুখটা মুছে দাঁড়ালো। রাস্তায় বৃষ্টির জল জমে। সেই জলে চাঁদের ছবি ভাসছে। কি মায়াময় ছবি। খিদে পেয়েছে, তবু ভালো লাগছে।
জলের উপর কি যেন পড়ল। ছলাৎ করে আওয়াজ হল। চাঁদের ছবি গেল ঘেঁটে। নন্দা সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
পিছন থেকে ডাকল কেউ, এই, শুনছ?
নন্দা ফিরে দাঁড়ালো। সে বলল, আমায় পুজো করবে না? আমিই তো লক্ষ্মী।
নন্দা চমকে তাকালো। বিজনদার ছোটোমেয়ে। জন্ম থেকেই এমন, মাথা খারাপ। কি অদ্ভুত সেজে দাঁড়িয়ে আছে। সারা কপাল এলোমেলো চন্দন। গলায় একগাদা গাঁদা ফুলের মালা। একটা শাড়ি যেমন তেমন করে পরা। আঠারো উনিশ বছর বয়েস হবে। খিলখিল করে হেসে একটা পাওডারের কৌটো নিয়ে লক্ষ্মীর মত দাঁড়ালো। বলল, এই পিসি পুজো কর।
নন্দা থ হয়ে দাঁড়ালো। কি করবে? এদিকে দেখতে দেখতে লক্ষ্মী রাস্তার উপর বসে গেছে। এত রাতে কাকে ডাকবে? ও তো উঠবেও না।
নন্দা ধূপের প্যাকেট বার করল। জ্বালাবে কি দিয়ে? পাশে ধানক্ষেতে নেমে এক খাবলা মাটি তুলে তাতে কাঠিগুলো গুঁজে দিল। একটা ধানের শীষ লক্ষ্মীর পায়ে দিয়ে বলল, চ সোনা, তোকে বাড়ি নিয়ে যাই।
লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, বাড়ি যাব কি গো? আমার যে অনেক বাড়ি পুজো নিতে হবে! যাও, তুমি বাড়ি যাও। গলুকে মা খিচুড়ি খাইয়ে দিয়েছে।
গলু নন্দার ছেলে। নন্দা যখন বিধবা হয় গলুর তখন আটমাস বয়েস। গলায় দড়ি দিয়েছিল, মিল বন্ধ হল বলে গলুর বাবা। লক্ষ্মীরা নন্দার প্রতিবেশী।
নন্দা কিছু বোঝার আগেই লক্ষ্মী দৌড়াতে শুরু করে দিল। নন্দার পা টানছে না আর। জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মী। তার নূপুরের শব্দ ভেসে আসছে। একটা অজানা পাখি ডেকেই যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় ফুটিফাটা হয়ে যাচ্ছে চারদিক। নন্দার প্রচণ্ড কান্না পেল। ফাঁকা রাস্তায় লক্ষ্মীর ফেলে যাওয়া ধানের শীষে মাথা ঠেকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। রাস্তার ধুলো লাগছে নন্দার কপালে, নাকে, গালে। নন্দা কাঁদছে গলায় দড়ি দেওয়া গলুর বাবার জন্য, অভাবে বড় হওয়া গলুটার জন্য, নিজের জন্য, লক্ষ্মীর জন্য, লক্ষ্মীর বাবা বিজনদা, লক্ষ্মীর মা শেফালি বৌদির জন্য, আরো আরো অনেক কিছুর জন্য, অনেকের জন্য...যা স্পষ্ট নয়।
হঠাৎ নূপুরের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরল। লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে সামনে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। শাড়িটা বগলে ধরা। গলায় গাঁদার মালা। সারা মুখে ধুলোবালি মাখা। হাতটা বাড়িয়ে বলল, দেখো রক্ত... পড়ে গেছি…. আমায় কালী ধাক্কা দিল.. আমি কালীঠাকুর হয়েছি দেখো…
নন্দা শাড়িটা লক্ষ্মীর হাত থেকে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল, চ মা... তুই আমার লক্ষ্মী, দুর্গা, কালী সব..
লক্ষ্মী বড় বড় চোখে নন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কাঁদছিলে... কি করে জানলে আমি পড়ে গেছি….
নন্দা আর লক্ষ্মী জ্যোৎস্নার আলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সেই পাখিটা ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। জলের মধ্যে চাঁদের ছায়া আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ।