Skip to main content

দুটো ঘর। একটা শোয়ার, আরেকটা শোয়ার। একটা স্নানের ঘর। সামনে একফালি উঠান। মা মেয়ে বসে আছে ক্যাম্পখাটে। সন্ধ্যে নেমেছে অনেকক্ষণ। এটা বস্তি। উদ্বাস্তুদের বস্তি। দুটো শোয়ার ঘর খালি। এই সময়টা ঘরে লোক থাকে। এখন নেই।

মেলায় কীর্তন চলছে। খানিক আগে চলছিল বাউলগান। চাঁদ অশ্বত্থগাছের ফাঁক দিয়ে মা মেয়ের বাড়ি, উঠান দেখছে। শুদ্ধ দেবতার মত। গুমোট গরম। আজ বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। আজ দুটো শোয়ার ঘরে লোক আসার কথা ছিল।

বৃদ্ধ বাউল। ক্লান্ত। গান আছে। খিদে আছে। স্বপ্ন আছে। ভাঙা স্বপ্নের ভার আছে। এসে জিজ্ঞাসা করল, স্নান করব মা…. গত বছর করেছিলাম… দশটাকা নাওনি। পাঁচটাকা নিয়েছিলে। এবার দশটাকা নাও। স্নান করব। দেবে?

=====

স্নানের ঘর থেকে গান আসছে। বাউল গাইছে মাথুর। চাঁদ গলে গলে ঢলে যাচ্ছে পশ্চিমে। ছাতিম গাছ, বটগাছ, পেয়ারা গাছ..কেউ ধরে রাখতে পারল না তাকে। দেবতাকে ধরে রাখা যায় না। মানুষকেও না। ধরতে গেলে দেবতা উধাও হয়ে যায়। মানুষ পচে যায়।

স্নানঘর থেকে গান আসছে মাথুর। কীর্তন গাইছে বাউল। কৃষ্ণ এসে দাঁড়িয়েছেন। সরলতায় মাখা মুখ। সরলতায় আঁকা চোখ। চোখের কোলে সরল কাজল। ঠোঁটের আগায় হাসি।

এ জগত শঠের। ক্রুরের। মা হাঁটুটা বুকের কাছে মুড়ে তার উপর মাথাটা রেখেছে। সবুজ নাইটিটা উঠেছে খানিক। পায়ের নূপুরে ঠিকরাচ্ছে চাঁদের আলো। মেয়ে মাথার নীচে ডানহাতটা মুড়ে রেখে ক্যাম্পখাটে শুয়ে। তার নীল জামায় লাগানো কাঁচের উপর চাঁদের আলো। গান আসছে মাথুরের। বিরহের। বেদনার। ভালোবাসা বড় শুদ্ধ জিনিস। রত্ন। পাওয়া যায় না। কোনো কোনো ভাগ্যবান পায়। বাউলের কান্নায় ভালোবাসা ভিজে পুড়ছে। পুড়তে পুড়তে ভিজছে। বাউল শোয়ার ঘর চায় না। স্নানের জল চায়।

====

বাউল স্নানের পর আবার তার নোংরা পোশাক পরে বাইরে এসেছে। মা, মেয়ে বসে খাটের উপর। বাউল বসল ঘাসে। শোয়ার ঘর দুটো লজ্জায় পিছন ফিরে, ওদিকে ডোবার দিকে তাকিয়ে। অভিমান বোবা সন্তানের মত মায়ের বুক আঁচড়াচ্ছে। অতৃপ্ত মানুষী বাসনা মেয়ের হৃদয়ে মাথা খুঁটে মরছে। বাউল দুই হাতে নিজের হাঁটুদুটো জড়ো করে জড়িয়ে বসে।

বাউলের সঙ্গে এসেছেন কৃষ্ণ। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। আলোয় দাঁড়ায় শঠ। সরলতার মুখোশে। সরলতা দাঁড়ায় অন্ধকারে। শিশির ভেজা ঘাস বানিয়ে যায় সে। কৃষ্ণের বাঁশি শিশিরের বিন্দু জমাচ্ছে। বাউল গুনগুন করছে। মেলায় কীর্তনের ফাঁকে ফাঁকে ঘোষণা হচ্ছে। কে যেন হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজছে তার বাড়ির লোক।

মা বলল, চা খাবে? মেয়ে হাতটা মাথার নীচ থেকে সরিয়ে পাশ ফিরে শুলো। বাউলের দিকে তাকিয়ে। দুই পল্লবে কাজল। তীরের মত। মাঝে সাদা দুধেল নদীতে ভাসছে নৌকা। কালো নৌকা। মণি। তীর খুঁজছে। বাউলের দিকে তাকিয়ে দুটো নৌকা ভিড়তে চাইছে। চোখ না ভিড়লে কি হৃদয় ভেড়ে বাউল?

বাউল বলল, তোমরা তো ফাঁকা আছ। চলো মেলায় চা খেয়ে আসি। আমার নাতনি চায়ের দোকান দিয়েছে। কী হাত গো মেয়ের। ওই টাকা দিল আমায়, বলল, যাও গিয়ে স্নান করে এসো।

=====

বাউল চলল আগে। পিছনে চলল মা মেয়ে। স্নানঘরে মাথুরের সুর রেখে। দুই শোয়ার ঘরে তালা লাগিয়ে। আজ ফিরে যাবে সবাই। এক একদিন ফিরিয়ে দেওয়ার গর্ব পেতে ভালো লাগে।

বাউলের নাতনির কপালে সিঁদুরের দাগ। কালো ছেলেটা ওর স্বামী। চপ ভাজছে। মা, মেয়ে নাইটি ছেড়ে শাড়ি পরে এসেছে। সাজ তো আগেই ছিল। এখন সাজের দরকার নেই। মেলাতে হারিয়ে গেলেও কেউ খোঁজার নেই। সাজ মানে তো ঠিকানা। পরিচয়। তাদের শরীরের পরিচয় আছে, হৃদয়ের?

একটা বেঞ্চে বসল মা মেয়ে। বাউল বসল মাটিতে। উবু হয়ে। ওর ওই স্বভাব। নাতনিকে বলল, এদের চা দে তো মা দুটো….এরা আমার আত্মীয়…. এই মেলার আত্মীয়। আমায় কম টাকায় স্নানের জল দেয়। বড় দয়ার শরীর মা এদের।

মা আকাশে দেবতাদের দিকে তাকালো। শিশির শুধু ঘাসেই না, চোখের পল্লবেও জন্মায়। তিরতিরে ব্যথা নিয়ে জন্মায়। মেয়ে উদাস। মেলার দিকে তাকিয়ে। ভালোবাসা মানে কি পুরুষ? নারীকেও কি ভালোবাসা যায় না? একজন পঙ্গু মেলার ভিড়ে যাতায়াতের পথে বসে ভিক্ষা করছে। বিকৃত শরীর তার। জন্ম থেকেই। ও প্রতিবছর আসে। এই মাঝরাস্তায় ধুলোর মধ্যে বসে। পাশে ওর চাকা লাগানো কাঠের গাড়ি। হাত দিয়ে মাটি ঠেলে ঠেলে চলে। কোথায় যায় না। শুধু চলে। এত মানুষের পায়ের কাছে বসে বসে ওর যাওয়ার রাস্তা হারিয়ে গেছে। একদিন ও যখন আর আসবে না, তখন এখানে একটা কুকুর শুয়ে থাকলেও কারোর কিছু মনে পড়বে না।

“নিন, চা।”

দুটো কাঁচের গেলাস ধরে দুটো সুখী হাত। সুখের গন্ধ। এ রত্ন। সবাই পায় না। ক্ষোভ নেই মায়ের। মেনে নিয়েছে। মেয়ের আশা আছে আজও। তাই ক্ষোভ নেই, অপেক্ষা আছে। একদিন অপেক্ষা কুয়াশা হবে। মা ভাবে, মেয়ের দিকে তাকিয়ে, কুয়াশায় মানুষ নষ্ট হয়। যদিও এই কুয়াশা জন্মাতো না, যদি সেদিন মা বলত, হ্যাঁ, এই সেই ভালোবাসা তোর। বরণ করে নে। সে ভালোবাসা এসেছিল মেয়ের জীবনে। মা স্বস্তির বাণী বলেনি। ভয় পেয়েছিল। ভয় অন্ধকারের মধ্যে জন্মানো ছায়া। সে ছায়া স্বস্তি দেয় না।

=====

রাত গড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝ রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাত জিরোয়। মা মেয়ে আলাদা ঘরে শুয়ে। দাঁড়িয়ে পড়া রাত, জিজ্ঞাসা করছে, সদর দরজায় দাওনি তো তালা?

দরজায় মৃদু টোকা।

দরজা খুলে দাঁড়ালো মা মেয়ে। সামনে দেবতার স্নানশুদ্ধ আলোয় দাঁড়িয়ে কালো মাণিক। বাউলের জামাই।

কাকে?

মা কে।

মানুষের মন পাশা খেলে। মানুষের যুক্তি সঙ্গে। কী চাল দেবে কেউ জানে না। হয় তো বাউলের নাতনিই পাঠিয়েছে তাকে। সে নিজে ক্লান্ত। সে জানে এ পুকুরে জল নেই ডোবার মত। একটু ঘাড়ে মুখে চোখে জল দিয়ে সে যাবে চলে। জড়িয়ে নাতনিকে যাবে তলিয়ে ঘুমে।

মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ধান ভাঙা হচ্ছে। গোলায় ভরা হচ্ছে ধান। পুকুর থেকে মাছ তোলা হচ্ছে। ক্ষেত জুড়ে পালংশাক, নটেশাক, পাটশাক। পেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে খিদে। কোলের কাছে শিশুর মত মৃত ভালোবাসা স্তনপানের জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। যে হাতে আঙুল নেই একটাও।

ভোর হল। কী কুয়াশা! এই কুয়াশায় নষ্ট হয় মানুষ। আলোয় না। অন্ধকারে না। কুয়াশায় নষ্ট মানুষ। এ জগত শঠের। বাউলেরা তো পরিযায়ী। দেবতারা ক্ষণজীবী। অমর আত্মা শূন্যের মত নিরাকার। এ জগতে দীর্ঘজীবী হয় শঠ।

স্নানঘরে মা শুনল মাথুরের কান্না। মেয়ে শুনল, ডাক। হারিয়ে যাওয়ার।