Skip to main content

রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, বিদেশ থেকে, রথীন্দ্রনাথকে। সালটা ১৯২৯।

“আমরা বাঙালীরা ঘোর পাড়াগেঁয়ে, হঠাৎ শিক্ষিত হয়ে বুলি আওড়াতে শিখেচি, বিদ্যাকে অন্তরঙ্গ করে নিতে পারি নি। সেইজন্যে আমাদের দেশে পলিটিক্স ছাড়া বুদ্ধিগ্রাহ্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে অধিকাংশ লোকেই রস পায় না। ওখানে ভালো করে ভাববার ও কথা কবার সুযোগ হয় না- নিতান্ত খেলোরকমের আলোচনায় ওখানকার দিন রাত্রি ফেনার মতো ভেসে চলে যায়- মানুষগুলো সজীব খবরের কাগজ- চিন্তার চেহারা অবাস্তব পোলিটিকাল বক্তৃতামঞ্চ ও দৈনিক কাগজের ছাঁচে ঢালা।

এখানে দুএকজন বাঙালীর সঙ্গে দেখা হল- ভালো লাগলনা- মনে হয় যেন তারা গুপ্ত সুরঙ্গের মধ্যে বাস করে- কোথা থেকে এসেচে, কি যে করচে কিছুই বোঝা যায়না।”

লেখাটার বয়স প্রায় একশো বছর হতে চলল। খুব কি কিছু পার্থক্য হয়েছে আমাদের? আমাদের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি বেড়েছে। পাশের হার বেড়েছে। কিন্তু ভোট এলেই বোঝা যায় আসলে আমরা নিজেরা কতটা বেড়েছি। রবীন্দ্রনাথ গ্রামের বিকাশের জন্য ভেবেছেন, কিন্তু গ্রাম্যতাকে বাদ দিয়ে। কিন্তু সেই গ্রাম্যতার ছাপ কি আমাদের আচরণে, বাক্যে, এই সোশ্যালমিডিয়ায়, রাস্তায় ঘাটে ব্যবহারে নেই?

আসলেই তাই। শিক্ষাকে আমরা সত্যিই ভিতরের জিনিস করতে পারিনি। ডিগ্রি বেড়ে চলে, সঙ্গে অদ্ভুত অভব্যতাও। আত্মবিশ্বাসের ক্ষয়, আত্মমর্যাদাবোধের ক্ষয়, চাতুরীতে প্রগাঢ় বিশ্বাস-শ্রদ্ধা - এর থেকে কতটা দূরে যেতে পেরেছি আমরা?

অজ্ঞতার গুহার কথা প্লেটো লিখেছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে আলোর মধ্যে দাঁড়ানোর দর্শনের কথাও লিখেছিলেন। আমাদের উপনিষদে হৃদয় গুহায় সত্য-আনন্দের উৎস সন্ধানের তত্ত্বও আছে, রবীন্দ্রনাথের লেখায় যা বারে বারে এসেছে। কিন্তু এ কোন গুহা? এ সেই বিবেকানন্দ থেকে সত্যজিৎ রায়ের বলা, কূপমন্ডুকতার গুহা। নিজেকে উদ্ধার করতে না চাইলে কারোর সাহায্যে কিছু আসে যায় না। শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য যদি ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো আর আখের গুছানো হয় তবে সত্যিই মানুষ হিসাবে আমরা ব্যর্থই হই। মানুষ বলতে যার মধ্যে বিদ্যা সচল। বিদ্যা বলতে যেখানে বুলি নয়, কৌশল নয়, চাতুরীকে আরো তীক্ষ্ম করার উপায় নয়। কিন্তু সে আলোর সাধনে কি আদৌ আমাদের রুচি আছে? মানুষ হিসাবে নিজেকে না দেখে, একজন কনজিউমার হিসাবেই শুধু দেখলে সব কিছুর মানদণ্ড বদলে যায়। সে বদলের দিকে আমাদের লোভ পা বাড়িয়েই আছে। শিক্ষাকে তার অনুষঙ্গ হিসাবে পেতে চাইছি। এ রাস্তা আর কোন দিকে নিয়ে যাবে তবে?