ছোটোবেলায় একটা স্বভাব ছিল দু পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে কুয়োর মধ্যে ঝুঁকে দেখা। কুয়োটা নিয়ে আমার মনে যে কি রহস্য ছিল সে বলার নয়। মাথা ঝোঁকালেই জলে আমার মাথার ছায়া। একটা ঢিল ফেলে দিলেই মাথা দুলে উঠল। মাথার পিছনে কখনও নীল আকাশ, কখনও সাদা-কালো মেঘের আকাশ। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, কুয়োর নীচটা কত অবধি গেছে? শুধুই কি জল, জল, আর জল। ওর মধ্যে ব্যাঙ আছে, সাপ আছে, তিমি আছে, ভূত আছে। আরো কত কত কি আছে যা শুধু কুয়োই জানে, আর কিছুটা বড়রা জানে!
বড় যত হলাম, কুয়ো তত কুয়ো হয়ে উঠল। রহস্য সব হারিয়ে গেল।
হৃদয়ের মধ্যেও অত ঝুঁকে না দেখাই ভালো। সে নিজেরই হোক, কি অন্যের। যাকে ভালোবেসেছি, তার হৃদয়ে ঝুঁকে পড়ে নিজের ছায়া দেখার বিলাসিতা ভালো নয়। ওতে অশান্তিই বাড়ে। কার হৃদয়ের কুয়োয় যে কি আছে সে নিজেই জানে না। আমি নিজেই কি জানি নিজের হৃদয়কে? জানি না তো। আবছা ধারণা হয়। সে ধারণা স্পষ্ট হওয়ার আগেই ভুল প্রমাণিত হয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
কুয়ো থেকে কখনও গরল কি ওঠেনি? বিষবাষ্প? উঠেছে তো। তা নিয়ে লজ্জাও তো কম পাইনি। তার পরিচর্যা করতে হয়েছে। সতর্ক হতে হয়েছে। পানীয় জল, কি স্নানের জল না দিতে পারি, কিন্তু গরল দেওয়ার কি মানে?
অন্যের হৃদয় থেকেও কি শুধু মিষ্টিজল পাওয়া যায়? পেলে তা ভাগ্যের। কিন্তু না পাওয়া গেলে? ঝুঁকে পড়ে অমৃত বা বিষ, দুইয়ের খোঁজেই লাভ কি? সরে আসাই ভালো। যদি কেউ গরল তুলে দেয়, কি কুয়োর তলা থেকে নুড়ি কুড়িয়ে মারে, তার জন্যে নিজের কুয়োয় নুড়ি জমিয়েই বা লাভ কি? বরং সে ক্ষেত্রেও সরে আসাই ভালো। না হয় ক'টা ঢিল খেয়ে গেলে অত ক্ষতি নেই, যত ক্ষতি অন্যের কুয়োর আবর্জনা সামলাতে নিজের কুয়োয় সেই আবর্জনা জমিয়ে রাখার ইচ্ছাতে।
তবে কি আত্মরক্ষা করার কিছুই নেই? আছে। তার জন্যে গভীরে বিষের কারখানা গড়ার দরকার নেই। কুয়োর চারপাশে কিছু ইটপাটকেল পড়েই থাকে। ফোঁস করতে চাইলে সে-ই যথেষ্ট। বিষ ঢালার দরকার কি?
ছেলেবেলায় কুয়োয় মাথা নীচু করে দেখতে গেলে বড়রা বকাবকি করতেন। বলতেন, ওরে পড়ে যাবি, ডুবে মরবি!
এখন নিজেকে বকাবকি করি। হৃদয়ের যতটুকু দেখা যায়, সে-ই যথেষ্ট। অত তলিয়ে দেখায় কোনো সুখ নেই। শুধু সময় নষ্ট। অন্যের মধ্যে যতটা দেখি সে-ও আসল কি নকল হিসাব কষেই বা কি হবে? আসল হলে স্মৃতিতে বাস হবে, নকল হলে হারিয়ে যাবে! মিথ্যা তার আয়ুষ্কাল আছে বলেই মিথ্যা। কিন্তু ওই দঁকে ডুবে মরার কোনো মানে হয় না। চরৈবতি, চরৈবতি বলা হয়েছে। ডুবে ডুবে মরৈবতি তো আর বলা হয়নি। যদি বলো, ডোবার কথাও যে আছে, হৃদিগুহায়। সেও আছে। তবে কি, সামনে সোজা পথে চলতে চলতে সে হৃদিগুহা আপনিই খুলে যায়। কিন্তু সব থামিয়ে ডুবতে গেলে শুধু বিকারই জমে। চলার মধ্যে যে আনন্দ, সে আনন্দ আর কিসে?