Skip to main content


        সন্ন্যাসী নদীর তীরে। একটাই গেরুয়া। স্নানের পর নগ্ন শরীরে বসে। পাশে মেলা গেরুয়াবাস। সন্ন্যাসীর চোখে বিতৃষ্ণার দৃষ্টি। সংসার - মিথ্যা কুহকাবৃত ছলনার স্রোত, মূঢ় মানুষ। শুদ্ধতার সাধন নেই।
        দূরে এক জেলে, পাঁকের মধ্যে হাঁটু অবধি ডুবে, জাল ফেলেছে জলে। সন্ন্যাসী করুণা আর উপেক্ষায় তাকাল সেই দিকে। মনের গভীরে গভীর আত্মপ্রসাদ - পাঁকহীন এতটা পথ পার হয়ে আসা গেল সংসারে। ঈশ্বর করুণাময়। পাঁকের থেকে বাঁচিয়েছেন তাকে।
        খানিক পর এক রমণী এল। এ গ্রামের প্রসিদ্ধ গণিকা। সন্ন্যাসীকে কটাক্ষে দেখে, বিনা সঙ্কোচে এক এক করে বাস ত্যাগ করে নেমে পড়ল জলে। পুরুষজাত তার করুণার যোগ্যও নয়। সন্ন্যাসীর বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়েছে গত শ্রাবণে। তার উঠে পড়ার কথা। কিন্তু সন্ন্যাসী উঠতে পারল না। এতদিনের ব্রহ্মচর্য কি এই এক বেশ্যার অঙ্গমোহে ভেঙে পড়তে পারে? সন্ন্যাসের পৌরুষে লাগল। হাজার হোক সন্ন্যাস তো পৌরুষেরই অঙ্গ। তাই তো সন্ন্যাসিনীদেরও অমন পুরুষসুলভ বাসের রীতি, আসলে তা তো অনুকরণের। পুরুষের অনুকরণ।
        রমণী উচ্চৈস্বরে বলে উঠল, ক'টা মাছ পেলে গো বিধান?
        জেলে এদিকে না তাকিয়েই বলল, এখনও ওঠেনি রে চম্পা।
        জেলে একবার দূরে নদীর ওইকূলে তাকালো। অস্পষ্ট কয়েকটা শিশু মানবসন্তান। ওদের মধ্যে দু'জন তার। লক্ষ্মী এতক্ষণে উনুনে আঁচ দিয়ে ফেলেছে। ওই দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার রেখা সরু সুতোর মত।
        সন্ন্যাসীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পেটের মাংসপেশীগুলোতে মোচড় দিচ্ছে। খিদে পেয়েছে কি? কিন্তু এতো আহারের যন্ত্রণা না? প্রভাতেই তো আহার হয়েছে সমাধা, চিঁড়ে দই দিয়ে। বুকের মধ্যে ঈশ্বরের ধ্যানের পদ্মের পাপড়িতে আন্দোলন হচ্ছে। সন্ন্যাসী উলঙ্গ অবস্থাতেই বসল ধ্যানে। তুই তুচ্ছ পাপদ্বারী নারী হতে পারিস উলঙ্গ সন্ন্যাসীর সামনে, আর আমি ত্যাগের পৌরুষকে করব লজ্জিত সরে গিয়ে, কখনও না!
        সন্ন্যাসী চীৎকার করে, নাভির গভীর থেকে শ্বাস নিয়ে বলে উঠল - ব্যোম শঙ্কর! পাশের বাবলা গাছে বসা কয়েকটা কাক চমকে উঠে পালিয়ে গেল। একটা মাংসের টুকরো পড়ল মাটিতে, কোনো কাকের মুখে ধরা ছিল হয়ত। রমণী ডুব সাঁতার দিয়েছিল, জলের তলা থেকেই সে শব্দ পেয়ে জলের উপর মাথা তুলে বলল, মরণ! জেলে একবার তাকিয়ে মুখ ফেরালো।
        সন্ন্যাসীর মাথার মধ্যে প্রতিটা শিরায় মনে হচ্ছে আগুন ছুটছে। এত বাস্তব জ্বলন্ত অনুভূতি তার জীবনে খুব কম হয়েছে। তার বারবার মনে হয়েছে সে এ সবের ঊর্দ্ধে বহুদিন। ঈশ্বর তো এত প্রত্যক্ষ নয়, তবে জীবন এত প্রত্যক্ষ কেন? কারণ এ ফাঁদ। এ অর্থহীন। তেষ্টা পাচ্ছে। উঠবে? উঠলেই তো সেই দৃশ্য। তবু উঠল। তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল সে? সন্ধ্যা হল কখন? আলো কমে এসেছে। নদীর পাড় শূন্য। জেলে ফিরে গেছে। এত গভীর ধ্যান তো তার সারা জীবন হয়নি। সে কার ধ্যান করছিল? মনের মধ্যে একটা বিষাদ আর প্রসন্নতা পাখির ডানার ছায়ার মত তার বুকের পাঁজর আড়াল করে বসল। সন্ন্যাসীর বুকে একটা তীব্র ব্যথা শাঁখের আওয়াজের সাথে সাথে জেগে উঠল। যেন তার ভিতরে কে হাত পা মেলে দাঁড়াতে চাইছে, কিন্তু পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না। তার বুকের মধ্যে ঈশ্বরের পদ্মদল থরথর করে কাঁপছে, উপড়ে যেতে চাইছে তার বুকের ব্রহ্মকমল। একটা নীল আলো তার মাথা বুক কাঁপিয়ে জেগে উঠল। সন্ন্যাসী দেখল নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে একটা নীলপদ্ম। সে কিছু বোঝার আগেই জলে ঝাঁপ দিল। হাতে নীলপদ্ম নিয়ে ছুটল।
        চম্পা তখন পূজো সেরে উঠেছে, দরজায় আঘাত লাগল। দরজা খুলে দেখে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী। তার হাতে নীলপদ্ম, চোখে জল, মুখের মধ্যে ভোরের আলোয় স্নাত গঙ্গামাটির পেলবতা। সে বলল, আমি বিয়ে করব তোমায়।
        গণিকা হেসে বলল, কেন সন্ন্যাসী, আমায় উদ্ধার করতে?
        সন্ন্যাসী নতমস্তকে বলল, না। 
        পাশের অর্জুন গাছে বসা একটা কোকিল ডেকে উঠল অবেলায়, অসময়ে, এ যে শরতকাল।
        গণিকা বলল, হাতে ও কি?
        সন্ন্যাসী বলল, নীলপদ্ম।
        চম্পা বলল, বিধানদার বাড়ির। তবে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে, পারবেন?
        সন্ন্যাসী বলল, কি?
        "আপনাকে বিধানদার সংসারে তিনরাত কাটিয়ে আমার কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে। পারবেন?"
        সন্ন্যাসী বলল, পারব।

        তিন বছর ঘুরে পাঁচ বছর হয়ে গেছে, সন্ন্যাসী ফেরেনি। চম্পার ব্যবসা বেড়েছে। বিধানের আরেকটা ছেলে হয়েছে। সন্ন্যাসীকে আর দেখতে পাওয়া যায়নি। আরো পাঁচ বছর পরের ঘটনা। কয়েকদিন ধরে ভীষণ বর্ষা হচ্ছে। 
        চম্পার বাড়ির দরজায় দেখা গেল সন্ন্যাসীকে। চম্পা প্রথমে চিনতে পারেনি। সন্ন্যাসী এখন বৃদ্ধ। তার মুখের লাবণ্য, তেজ সব শুকিয়ে একটা পাংশু বর্ণ করুণ করেছে তার মুখকে। চম্পার করুণা হল। সন্ন্যাসী বলল, বিধানের শেষ সন্তানটি তার। কি করে কি হল চম্পা জিজ্ঞাসা করেনি কোনোদিন। সন্ন্যাসীও বলেনি। চম্পার ঘরটা আজ বারো বছর হল শূন্য পড়ে আছে। বিধানের নামে নাকি সে বাড়ি লেখাপড়া করা আছে, লোকে বলে।

        লক্ষ্মীর দরজায় যেদিন সন্ন্যাসী এসে দাঁড়ালো সেদিন লক্ষ্মীর হাতের ঝাঁটা পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল তার শিরদাঁড়ার শিহরণে। লক্ষ্মীর কাছে বিধান অগম্য, ভালোবাসা নেই; জান্তব অভ্যাস কি ভালোবাসা হয় কোনোদিন? তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের ভার ক্ষুধার্ত শরীরের থেকে লক্ষগুণ বেশি। তাই সন্ন্যাসীর চোখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মী ঠিক প্রেমে পড়েনি, নিঃশব্দ আর্তনাদ করে উঠেছিল। কঁকিয়ে উঠেছিল লোভে। বিধান সন্ন্যাসীকে তার বাড়িতে ঠাঁই দিতে আপত্তি করবে না লক্ষ্মী জানত, সে ধর্মভীরু। তেত্রিশটা বসন্ত কেটেছে এই দৃষ্টিটার জন্য। তাকে ফেরানো যায় না, ঈশ্বর সংসারবাসী না, হৃদয়বাসী। লক্ষ্মীর সমর্পণ ফেরাতে পারেনি সন্ন্যাসীর দ্বিধান্বিত দুর্বল মন। বর্ষার বেনোজলের মত তার কঠোর অমানবিক সংযমের ভিত ভাসলো। মুক্ত হয়ে জন্মালো নতুন জীবনে। কিন্তু সেই জীবনকে আলিঙ্গন করার সামর্থ্য তার শরীর আর বিবেকের ছিল না - কিছুটা বয়েসের ভারে কিছুটা আহত সাধন পৌরুষের গ্নানিতে। যে রূপে আমরা তাকে এত বছর পর চম্পার কুটিরে শেষবারের মত দেখেছিলাম তাদের অন্তর্হিত হওয়ার প্রাক মুহূর্তে।