বিরুপাক্ষের ডিসেম্বরের শেষ তারিখ এলেই মন খারাপ লাগে। বছর শেষ হচ্ছে বলে নয়, ক্যালেন্ডারটা ফেলে দিতে হবে বলে। অ্যাদ্দিন মুখোমুখি কাটানো। গোটা একটা বছর। কম কথা! সুখেদুঃখে, গ্যাসে-অম্বলে, আমাশায়-কোষ্ঠকাঠিন্যে.. বারবার এই ক্যালেন্ডারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফেলে দেবে?
নতুন ক্যালেণ্ডার কিনে রোল করে রাখা টেবিলে। বিরুপাক্ষ বসে বসে ভাবছে, জীবন কি নির্দয়। কত মানুষ ঠকিয়ে গেল। আরো যাবে। সে সব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। "অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে / সে পায় তোমার হাতে / শান্তির অক্ষয় অধিকার।" রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা। কিছু ভেবেই নিশ্চয় লিখেছিলেন। বিরুপাক্ষ নিজেকেও কি ঠকায়নি? পেট গোলমাল করছে, তবু হরেনের আলুর চপ চিবোতে চিবোতে নিজেকে বলেনি "ও কিচ্ছু হবে না"? বলেছে তো। ফলও পেয়েছে।
যদি শান্তি চাও কারোর দোষ দেখো না। সারদাদেবীর কথাটা বড় জ্বালায় বিরুপাক্ষকে। রাজনীতি করা মানুষ। অন্যের দোষ না দেখলে মাইকে দাঁড়িয়ে বলবে কি? ভাগবত? তাই হয়? পরীক্ষিতের আর সাতদিন আয়ু ছিল তাই ওসব ভাগবত-টত শুনেছিল। জীবন তো কুরুক্ষেত্র। মহাভারত। তবে? তবে এই যে কারোর বিশ্বাসঘাতকতায় আর কষ্ট পায় না বিরুপাক্ষ এখন। এইতে মনে বেশ একটা শান্তি এসেছে। এইটাই বলেছিলেন বোধহয় মা, যদি শান্তি চাও তবে কারোর ছলচাতুরীর হিসাব রেখো না, ছলচাতুরী দেখবে নিজের। সত্যিই নিজের মনের ছলচাতুরী ধরতে পারলে মেলা মনের ঝক্কি পোহাতে হয় না।
বিরুপাক্ষ বাইকটা নিয়ে বেরোলো। আজ পার্টির পিকনিক আছে। বেশ ফুরফুরে লাগছে মেজাজটা। সরকারে না আসতে পারলেও কি হবে, কাজটাই আসল। সেটা যদ্দূর মন দিয়ে করা যায়। ছলচাতুরী থাকবে। সে ছাড়া আর কি হয়? মহাভারতেও হয়েছে। গোটা জীবনটাই তো তাই, ঠেক খেতে খেতে হাড়গোড় শক্ত করা।
ফোন এলো। পচাদার সকালেই হার্ট অ্যাটাক। হাস্পাতালে নিয়ে যেতে যেতেই….
পিকনিক ক্যান্সেল। যদিও পচাদা অন্য পার্টির। তবু মানুষটাকে ভালোবাসত সবাই। বিরুপাক্ষ বাইকটা স্ট্যাণ্ড করে পুকুর ধারে এসে দাঁড়ালো। চোখের কোল চিকচিক করছে। জল এসেছে। শীতের হাওয়ায় আরো ঠাণ্ডা লাগছে।
পুকুরে ছিপ ধরে বসে আছে জগা। মাছ ধরছে। সারা জগতে সব ছিপ ধরে বসে। কে যে কাকে কোথায় তুলছে। তবু মানুষের জন্য কাঁদে মানুষ। নইলে এই একা একা দাঁড়িয়ে কাঁদছে কেন সে?
সব ছলনা হেরে যায় মানুষের কান্নায়। মানুষ একা কাঁদলে ছলনা সরে যায়। বুকের মধ্যে মা জেগে ওঠে। সন্তানের একা কান্নার শব্দ শুধু মা পায়। সে কুকুর বেড়াল যাই হোক না কেন। দেখেছে বিরুপাক্ষ। ঝড়ের রাতেও বাচ্চাকে মুখে করে মা নিরাপদ ডেরা খুঁজছে।
বিরুপাক্ষ চোখ মুছল। বাইক ঘোরালো। পচাদার বাড়ি যাবে। কি আশা করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল কি হল। আশাই হল কুইন অব ছলনাময়ী।
বিরুপাক্ষের বাইক শীতের নরম রোদ ভেদ করে যেন ভেসে যাচ্ছে। বিরুপাক্ষ গাইছে রামপ্রসাদী.... "নিম খাওয়ালে চিনি বলে কথায় করে ছলো....."
রামপ্রসাদও বুঝেছিল। না বুঝে যাবে কই আর!