মানুষ কি জন্মায় তবে শূন্য সাদা কাগজ হয়ে? নাকি মানুষের সত্তার গভীরে জন্মলগ্ন থেকেই কোনো বোধের ইঙ্গিত থাকে, কি বলেন মশায়?
-- দেখেন, এই নিয়ে পাশ্চাত্যে ক্যাঁচালের শ্যাষ নাই। দেকার্ত, স্পিনোজা, লাইবিনিৎজ মহাশয় তো বলেন কয়েকখানা নামতা মুখস্থ করেই মানব সংসারের সিংহদুয়ারে এসে দাঁড়ায়। বাকিটা নানা অভিজ্ঞতার রঙে রাঙা হয়ে ওঠে মানুষ। তাই এত নানা রঙের মানুষ। যেমন বুঝলেন কিনা, ঠাট। আপনে যদি মার্গসঙ্গীতের কথা বোঝেন, তবে মাত্র কয়েকখানা ঠাটের উপর এত রাগরাগিণী।
-- সে বুঝি না।
-- বেশ, প্রাইমার বোঝেন? মানে দরজা-জানলা রঙ করার আগে কেমন একটা সাদা পট্টি মারে। তারপর আপনে লাল, বেগুনী, গেরুয়া, সবজে ইত্যাদি যা হোক লাগান একটা। অনেকটা সেরকম।
আর অন্য তত্ত্বটা?
-- অর্থাৎ কিনা বেকন, লক, হিউম ইত্যাদি মহাশয়েরা বলেন যা কিছু সব এখানে এসে শিখি আমরা, মনে প্রথম থাকতি কোন রঙ নাই। সে প্রাইমারও বস্তু জগতের, রঙও জগতের। অভিজ্ঞতাই মূল।
-- এ দুই ভাবনার কি কোনো নাম আছে?
-- হুম, আছে বৈকি। জ্ঞান থাকবে আর সংজ্ঞা থাকবে না তাই কি হয় বাপু? কত মানুষ তো সংজ্ঞাকেই জ্ঞান বলে ধরে। দেখো বাংলা ভাষায় জ্ঞান আর সংজ্ঞা যদিও এক কথা, যেমন ধরো ওই যে বলে না, লোকটা সংজ্ঞা হারিয়েছে, তেমন আরকি, কিন্তু আমাদের এই সংজ্ঞা তো আর জ্ঞান নয় কো, এ হল ডেফিনেশান। অর্থাৎ বেশ কঠিন করে বললে - বস্তু নির্দেশক বাক্যকেই সংজ্ঞা বলা হয়। যাক গে, তা এদের দুই ভাবনার ভাবুকের নাম হল - আগে প্রাইমার পরে জাগতিক রঙ যারা বলে, তাদের বলে rationalist, আর এখানেই প্রাইমার মেখে রঙ মাখার তত্ত্ব যারা দেয় তারা হল গিয়ে এম্পিরিসিস্ট।
বেশ কঠিন নাম গো।
-- তা বটে।
-- আর আমাদের এখানে এসব নিয়ে কোনো কথা হয়নি কো?
-- হয়েছে, সে কথা পরে বলছি, তার আগে একটা কথা বলে নিই, ওদের দেশে এই দ্বন্দ্ব মেটাবার চেষ্টা কান্ট মহাশয় করতে গিয়ে rationalism এর দিকে এমন ঝুঁকেছেন যে সে কাজটা ঠিক হয়ে ওঠেনি জানো তো বাপু। তাই আমাদের সময়ের রাসেল মহাশয় কাণ্ট মহাশয়কে খুব একটা গুরুত্ব দেননি, হুম। আর আমাদের দেশে? সে অর্থে দেখতে গেলে আমাদের দর্শনে rationalism এর চাইতে মিস্টিসিজমের দিকটাই চলে বেশি। যদিও আমাদের প্রধান বিশ্বাস আত্মা সব জানে। নানা অভিজ্ঞতায় আত্মার সেই পূর্ণ জ্ঞানের বিকাশ হয় মাত্র। যেমন যেই না টুপ করে আপেল পড়াটা নিউটন দেখলেন, অমনি সে আপেলকে না উদরস্থ করে ব্যপারটাকে উনি যে মস্তিস্কস্থ করে তুললেন, এবং নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে সেই অভূতপূর্ব মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের আলো পেলেন, সেখানে আমাদের বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন যে সে তত্ত্বের আভাস তো আপেলের সাথে ছিল না, তবে তা নিউটন পেলেন কি করে? নিজের মধ্যে যুক্তি-বিচার করে। অর্থাৎ কিনা সমস্ত জ্ঞানের প্রধানভাগটাই আমাদের যুক্তিপ্রসূত। সেই যুক্তি নেড়েঘেঁটেই এই তত্ত্ব, মায় আপেক্ষিকবাদ অবধি। এবং আমাদের আইনস্টাইন মহাশয়ও সেই এক কথাই বলেন। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? তিনি সটান জবাব দিয়েছিলেন, করি, তবে সে স্পিনোজার ঈশ্বর।
-- সেটা কি?
-- সে হল অনেকটা আমাদের নির্গুণ ব্রহ্মের মত। বিশ্ব সংসারব্যাপী একটা জাগ্রত চেতনা, যা মানবিক আবেগ, সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতার অতীত, তাকে মানবীয় আবেগ-বোধ সম্পন্ন ভাবা যায় না। যেই চেতনার উন্মেষে মানুষ তার নিজের সীমারেখা অতিক্রম করে, নিজের নানা আবেগজাত দুর্বলতা অতিক্রম করে স্থিতধী হতে পারে। এই নিয়েই তো স্পিনোজার যুগান্তকারী বই ‘এথিকস’। আইনস্টাইন এত প্রেমে পড়েছিলেন মানুষটার যে তাঁকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখে ফেলেছিলেন, অথচ তাঁদের মধ্যে কত বছরের দূরত্ব!
-- বুঝলাম, তা সেই বইতে কি বুঝিয়েছেন স্পিনোজা?
-- মোদ্দা কথা এইটাই বোঝাতে চেয়েছেন যাই হোক বাপুরে এক অনন্ত চৈতন্যময় সত্তা তুমি তা ভুলো না, আবেগের ঢেউ সামলিয়ে ভেলা নিয়ে মাঝসমুদ্রে এসো। যা আছে, যা ঘটছে, তাকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করো নিজের বুদ্ধির বিচারে, কোনো আবগের তাড়নাতেও নয়, কি কোনো খামখেয়ালি স্বর্গস্থ ঈশ্বরের কল্পনাতেও নয়। অমন কোনো ঈশ্বর কোত্থাও নেই। ঈশ্বর অর্থে এক অনন্ত অসীম চেতনা, ব্যস এইটুকুই বোঝো।
-- বেশ কঠিন, অনেকটা আমাদের জ্ঞানমার্গের মত।
-- তা বটে। তবে কি জানো, জগতজোড়া একটা মানুষজাতি। তাই এর চিন্তার সাথে ওর চিন্তার কোনোখানে মিল এসেই পড়ে। সেই মিলটাও যেমন সত্যি, ফারাকটাও তেমন সত্যি, তবেই তো বৈচিত্রময় জগত হবে, নাকি?
-- হুম তো, রামকৃষ্ণ ঠাকুর যেমন বলতেন, সানাইয়ের সেই এক পোঁ আমার ভালো লাগে না, বেশ সাত সুরে বাজবে তবেই না সুখ!
-- বেশ বলেছ হে। কিন্তু দেখ কিছু মানুষ সব সময় থাকবে এও সত্য যারা জগত জুড়ে একটাই তত্ত্ব বানাতে চায়। ভাবো এরা ভাগ্যে দর্জি হয়নি, তবে বলত এই মাপের জামাকাপড় ছাড়া আমি অন্য মাপের কিচ্ছুটি বানাব না। তবে কি হত বলো, জগতে কত মানুষকে উলঙ্গ হয়েই বাঁচতে হত। তবে কি প্রকৃতি এরকম বাজে দর্জির দোকানের ঝাঁপ বেশিদিন খোলা রাখতে দেয় না।
-- সে তো হল, কিন্তু মোদ্দা কথাটা কি হল তবে?
-- দেখো বাপ, তোমায় একটা সার কথা বলে রাখি, সংসারে মোদ্দা কথা বলে কিছু হয় না। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে একটা কিছু মোদ্দা কথা দাঁড়ায়, তুমি সরে দাঁড়ালে সেও সরে যায়। মুশকিল হয় কি জানো, অনেকেই এই মোদ্দাকথার মায়ায় আর নড়তেই চায় না। একটা মোদ্দাকথা পেয়ে, তাকে নিয়ে সংসার পেতে এমন মায়ায় জড়িয়ে যায়, অন্যের কথা না পারে বুঝতে, না পারে মেনে নিতে। কি যন্ত্রণায় আর দুরাশায় যে তাদের জীবন কাটে...
-- যন্ত্রণা না হয় বুঝলাম, দুরাশা কেন?
-- আরে ভাই, দুরাশা নয়? তারা তো ভাবে তারাই ঠিক আর জগতে সবাই ভুল। এখন সবাইকে তাদের মোদ্দাকথার দাওয়াই না খাওয়ালে তো তাদের ঘুম হয় না। ফলে উদ্বেগ, সেই থেকে ক্রোধ, তার থেকে উন্মাদের মত আচরণ, আর বোলো না বাপু!
-- তবে মানুষ কি ধরে চলবে? একটা কিছু তো ঠিক করে নিতে হবে?
-- মানুষ নিজের পথ ধরেই চলবে, তবে গোঁড়ামিটা ছাড়তে হবে। ওই যে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা বললে না, ওইখানে একটা মজার গপ্পো আছে। একবার হল কি মাষ্টার মশায় সাররাত না ঘুমিয়ে সকালবেলা এসেছেন, বেশ দুশ্চিন্তার ছাপ চোখেমুখে। তা ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ গা, চোখমুখ এমন শুকনো কেন? কি হল? তা মাষ্টারমশায় তখন বললেন, আপনি আগের দিন যে সংস্কার ইত্যাদির কথা বললেন, আমি তা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না।
মাষ্টার তো প্রায় কেঁদেই ফেলে, বুঝলে কি না... ঠাকুর হো হো করে হেসে পিঠে হাত রেখে বলেন, আরে এই কথা... এইটুকুর জন্য এত চিন্তা... শোনো মানতে না পারছ, তা না পারছ। এতে ভাবনার কি আছে? শুধু একটা কথাই মনে রেখো, এরকম ভাববে না, আমি যেটা জেনেছি সেটাই শুধু ঠিক বাকি সব ভুল। তুমি বলবে, দেখো ভাই আমি বুঝেছি এরকম, ওইটা আমি বুঝিনি, ব্যস।
-- হুম, কি দারুণ কথাটা।
-- আসলে দেখো আমরা যতদিন বাঁচব ততদিন কিছু কিছু নতুন আবিষ্কার করেই যাব। তা বলে কি পুরোনোকে ফেলে দেব না পুরোনোকে নিয়েই শুধু থাকব? এই ধরো রাদারফোর্ড, বোর ইত্যাদিকে কি আমরা ভুলে গেছি? তা বলে কি আমরা কোয়ান্টাম ফিজিক্স কি আরো আধুনিক সব তত্ত্বের দিকে এগোচ্ছি না? আজ যদি বোর মহাশয় এসে দেখতেন আমরা সেই এক ওনার তত্ত্ব নিয়েই দাগ বুলিয়েই যাচ্ছি, বুলিয়েই যাচ্ছি, সেকি খুব একটা কাজের কথা হত? উনি কি কষ্টটাই পেতেন বলো?
-- হুম, তাই রামকৃষ্ণ ঠাকুর বলতেন শুনেছি, যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি, যদ্দিন বাঁচি তদ্দিন শিখি।
-- ঠিক আর এও বলতেন, তাঁর ইতি কোরো না। মানুষের যত গোল এই ইতি করতে গিয়েই, সে মূর্খ বোঝে না, তার জ্ঞানের ইতি করা মানে নিজের ইতি করা।
-- সত্যিই তাই। চলার আনন্দে না মজলেই মানুষ বসার ফিকির খোঁজে।
-- ঠিক তাই, তাই চলার আনন্দে চলাটাই কাজের কথা। কোথাও একটা পৌঁছাতে চাওয়ার তাগিদ যাদের তাদের চলাটা পায়ে শৃঙ্খল জড়িয়ে হেঁচড়েপেঁচড়ে চলার সামিল। তাতে না সুখ, না সার্থকতা।
বেশ বলেছেন, খুব খুশি হলাম আজকের কথাবার্তায়। আসি আজ, আবার আসব সময় হলে।
-- আসবেন, সময় হোক না হোক, মন হলেই আসবেন।