Skip to main content

আমি ওরকম ভীষণ শূন্য দৃষ্টি, ওরকম প্রাণহীন হাসি আজ অবধি দেখিনি। সারা ঘর শুধু বই আর বই। খাটে, মেঝেতে, তাকে শুধু বই আর বই। নানা দেশের ম্যাগাজিন। সব অগোছালো।

মানুষটার বয়েস হবে চুয়ান্ন পঞ্চান্নর আশেপাশে। তখন আমি কলেজে পড়ি। ওনার এক বন্ধু আমার হাত দিয়ে ওনাকে উদ্বোধন পত্রিকা পাঠাতেন। আমি পত্রিকা নিয়ে মাসে একবার করে যেতাম। আমায় ঘরে ডাকতেন। কফি খাওয়াতেন। ওনার বাড়িতে মানুষ বলতে ওনার মা আর অবিবাহিত বোন। উনি রেলে কাজ করতেন।

আমি কফিমগ নিয়ে মেঝেতে বসতাম। এ বই, সে বই ঘাঁটতাম। উনি নানা বিষয়ে কথা বলতেন। কথাগুলো ভীষণ এলোমেলো। ঠিক অসংলগ্ন নয়, কিন্তু যেন কথাগুলো না বললেও হয়। কথাগুলো যেন শুধু শব্দ, শুধু উচ্চারণ করতে হবে বলেই বলা।

ওনার বন্ধু, যিনি আমার বাবারও বন্ধু ছিলেন, একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার বন্ধু ওরকম কেন? এক মুখ দাড়ি, কাটে না। কিরকম সব কথা বলে....

শুনলাম ওনার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সংসার করা হয়ে ওঠেনি। সে মেয়েটা অন্য একজনকে ভালোবাসত। বাড়ি থেকে মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। এই ভদ্রলোক যখন সবটা জানতে পারেন, তখন সম্পর্কটা শেষ করে দেন। মেয়েটা তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে ফিরে যায়। ইনি অত্যন্ত আঘাত পান। আর বিয়ে করেননি।

এরপর যতবার ওনার বাড়ি গেছি, কফির মগ হাতে নিয়ে বসেছি, ততবার মনে হয়েছে কিসের থেকে যেন উনি পালাতে চাইছেন। নিজের থেকেই নিশ্চয়। ঈশ্বরের আড়ালে বাঁচতে চাইছেন। পালাতে চাইছেন। কিন্তু পারছেন না। সারা বাড়ি ধর্মগ্রন্থের অভাব নেই। সব বইগুলো যেন এক একটা গুহা। উনি লুকাতে চাইছেন। কিন্তু কোনো গুহাতেই থাকতে পারছেন না বেশিক্ষণ।

একদিন উদ্বোধন নিয়ে গেলাম। শুনলাম উনি মারা গেছেন। দুদিন আগে, রাত্রে হার্ট অ্যাটাক হয়। ওনার মায়ের হাতে উদ্বোধন পত্রিকাটা দিয়ে বললাম, আসি তাহলে। আমার একটুও কষ্ট হল না। মনে হয়েছিল উনি মুক্তি পেয়েছেন। এতদিনে সত্যিকারের পালাতে পেরেছেন।

ইতিমধ্যে ওনার বোন এসে দাঁড়িয়েছে মায়ের পিছনে। আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, দাদার আর কতগুলো পত্রিকা পাওয়ার আছে?

আমি হিসাব করে বললাম, আরো আটটা।

ওনার বোন বললেন, আমরা পত্রিকাটা আর নেব না, রামকৃষ্ণ মিশন জানালে ওরা বাকি টাকাটা দিয়ে দেবেন না?

আমি থ হয়ে ওনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কত টাকা হবে এক বছরের চাঁদা, মনে হয় একশো না একশো কুড়ি কিছু ছিল। আমার মনে পড়ছে না। কিন্তু অত্যন্ত অল্প কিছু টাকা। উনি যে পোস্টে চাকরি করতেন তাতে ওটা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।

আমার ভীষণ রাগ হল, আর কষ্টও হল। যার কাছ থেকে পত্রিকাটা আনতে যেতাম ওনার সেই বন্ধু তখন বাইরে বেড়াতে গেছেন। আমি কার কাছে এ ভীষণ প্রস্তাব নিয়ে যাব?

আমি বেশ কঠিন গলাতেই বললাম, জানি না, দেখছি!

ওনার জানলাটা খোলা। চৈত্রের বিকালের রোদ এসে পড়েছে ঘরে। পাশে মাঠে বাচ্চারা হুল্লোড় করে খেলছে। সব স্বাভাবিক। যেমন প্রতিবার এসে দেখেছি। প্যাভলভের কুকুরের মত আমারও মনে কফির তৃষ্ণা জন্মালো। ততক্ষণে মা মেয়ে দরজা বন্ধ করে ঘরে চলে গেছে।

একজন মানুষ এতটা নিঃসঙ্গ বেঁচেছিলেন, এতটা! আমার এইবার চোখে জল এলো। গরমে ঘামে, রাগে, কষ্টে, বিষ্ময়ে সাইকেল চালাতে চালাতে ঠিক করলাম আর কোনোদিন আসব না।

আজ বহুদিন পর ঘটনাটা মনে পড়ল। 'নোমাডল্যাণ্ড' সিনেমাটা দেখছিলাম, একজন নিঃসঙ্গ মহিলার ভবঘুরে জীবন নিয়ে সিনেমা। অসামান্য সিনেমা। অসামান্য। একজন বলছেন, there is no final good bye. আমাদের সবার সঙ্গে আবার সবার দেখা হবে।

সত্যিই তাই। শোক, দুঃখ আমাদের হৃদয়কে এক প্রাচীন শহরে পরিণত করে যেন, যেন অন্য সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোনো অর্থ নেই, তবু খোদাই করে চলেছি অতীতকে, কেন? কোনো উত্তর নেই।

শুধু বারবার মনে হচ্ছে, এত একা উনি বেঁচেছিলেন কিভাবে? কত অভিমান জমিয়ে নিজেকে অতটা নিঃসঙ্গ করে রেখেছিলেন। ভবঘুরে কি শুধু রাস্তায় নামলেই হয়, সংসারেও তো কত ভবঘুরে দেখলাম, যাদের কোথাও কোনো ঘর গড়ল না, ঘর থাকতেও।