সাইকেলের চাকার রিং-এ বেলা সাড়ে দশটার রোদ এসে পড়েছে। দাঁড়িয়ে কথা বলছেন বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে। মানে কেরিয়ার নিয়ে।
ডিসেম্বর মাসে পাশের বাড়ি সাঁই সাঁই করে ফ্যান ঘুরছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং। ২০২৩ নাকি উষ্ণবছর ঘোষিত হয়েছে। খবরের কাগজে কত কি খবর অ্যাকোরিয়ামের মাছের মত ভেসে বেড়ায়। হেনরি কিসিংগারের কবে ঘাটকাজ, মৎসমুখী সব লিখেছে ডিটেলসে কাগজে।
উনি কথা বলতে বলতে সামনের বাড়ির গাছের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ বছর আম কেমন হয়েছে এই গাছে?
প্রতিবেশীর গাছের খবর রাখাটা কেমন অভদ্রতা না? প্রতিবেশীর গাছের ফলনের নিন্দামন্দ, গালপাড়া, শাপশাপান্ত করা এইসব ভালো না। ওতে মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলে জগত খারাপ হয়। পেট খারাপ হয়। শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে। ওতেও গ্লোবাল ওয়ার্মিং বাড়ে। অনেক ডিগ্রী। তখন আবার এ-ওর ঘাড়ে বোমা ফেলে। এই হচ্ছে না দেশে-বিদেশে?
হেনরি কিসিংগারের গায়ে পড়ছে কাটা চালকুমড়োর খোসা, আলুর খোসা। কিসিংগার ভিজে যাচ্ছে। বাংলা হরফ ভিজে যাচ্ছে কিসিংগারকে নিয়ে। আজকের পেপার যে!
ছানি কাটা হয়নি অতসীর ঠাকুমার। সুগার কমছে না। কিন্তু বঁটি আর পাতকুয়া তলা পেলে কে বলবে চোখে ছানি? পেকে টসটস! ওপার বাংলা এখন গোটা একখানা দেশ। বাংলায় কথা কয়। কিসিংগারের গায়ের উপর আনাচের খোসা ফেলতে ফেলতে তাই কি জানাচ্ছে অতসীর ছানিওয়ালা এককালে কুমিল্লা নিবাসী ঠাকুমা?
সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে হাত রেখে ভদ্রলোক বললেন, উনি রোদে বসে আনাজ কাটেন কেন, চোখে রোদ লাগা তো খারাপ!
আমি বললাম, চোখে ছানি। তায় বহুকালের অভ্যাস। বলেন নিজের দেশেও নাকি ওরকম শীতে রোদে বসতেন। তখন শীত ছিল পৌষ মাঘ। এখন ডিসেম্বর জানুয়ারি। তখন শীত মানে ছিল শীতকাল। এখন শীতের আমেজকাল। ঠাকুমার পিঠে রোদ। রোদের মধ্যে ভিজে মুখ শুকাচ্ছে বাংলা কাগজের অক্ষরে কিসিংগার। নইলে অতসীর বাবা এসে রাগ করবে। অতসীর বাবার ভীষণ রাগ!
উনি বললেন, কি হয় দেখি! মেয়েটার ভবিষ্যৎ কি হয়। নইলে বিয়ে দিয়ে দেব।
ছেলে হলে কি বলতেন? সিগারেট বিড়ির দোকান? না রিকশা? না ঘর থেকে বার করে দেব?
জিজ্ঞাসা করলাম না। হাসলাম। কিছু হাসি বাক্যের শূন্যতার মেজোমামা। দুষ্টু মেজোমামা। এখনও বাংলার শাশুড়ি বনাম বউমা, প্রাক্তন স্ত্রী বনাম বর্তমান স্ত্রী নিয়ে সিনেমা হয়। এখনও অনেক মহিলার পরিচয়, "অমুকের বউ ছিল যে"। বিয়ে তো দেবেনই। অবশ্যই দেবেন। নইলে সমাজ মানুষ শব্দের মানে বোঝে না। মানুষ মানে বিয়ের যোগ্য, সন্তান উৎপাদন যোগ্য, সুচাকুরে/সুগৃহিণী কথাবলা জন্তুবিশেষ। বাকি সব বাড়তি!
আসলে আমাদের পরিবারকেন্দ্রিক সভ্যতা। দালানকোঠা থেকে ফ্ল্যাটের খুপরি। সব পরিবার নিয়ে। পরিবারে একা হও ক্ষতি নেই। পারিবারিক 'লোনার' বড় আঁতেলী সম্পদ। সহসা পাওয়া যায় না।
উনি চলে গেলেন। কিসিংগার নিয়ে একটাও কথা বললেন না। মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে ভাবতে ভাবতে মোড়ের পরে মোড় পেরিয়ে, গলির পরে গলি পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকবেন। দেখবেন খাটের উপর হাসিমুখে শুয়ে কিসিংগার প্রথম পাতায়। উনি পাতার পরে পাতা উল্টে দেখবেন - যে ওষুধগুলো হাস্পাতালে আসার কথা এসেছে কিনা.... বাইরে বড্ড দাম..... মেয়েটা বুঝছে না.... কেউ বোঝে না। এমনকি কিসিংগারও না।