এখানে সেখানে কেন মনোনিবেশ মন, মনোনিবাস তোর হবে কবে?
কিশোরী দাস বাবাজী, হালিশহর চৈতন্যডোবার মঠাধ্যক্ষ। চলে গেলেন। এমন নির্লোভ মানুষ আমি বড় কম দেখেছি। জীবনে সাধু সন্ন্যাসী বড় একটা কম দেখলাম না, অনেক জায়গায় অর্থের লোভ নেই হয়ত, কিন্তু মানের লোভ চূড়ান্ত দেখেছি। এ মানুষটা ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ধারার মানুষ। না তার মানের লোভ, না অর্থের।
একদিনের ঘটনা মনে পড়ছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একজন গবেষক এসেছেন, তিনি মহাপ্রভুর উপর কিছু একটা কাজ করছেন। গরমকাল, বাবাজী যে চৌকিতে বসে থাকতেন সেখানে কোনো পাখা নেই, নিজের গামছাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজেকে হাওয়া করতেন। ভক্ত, অভক্ত, দর্শক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক --- যারাই আসতেন এই চৌকিতে বসেই কথা হত।
সেরকমই একটা গুমোট গরমের দিন। আমি গেছি বিকালে, ওনার সামনে একটা চেয়ার পেতে বসেছি। আমাদের আলোচ্য বিষয় মহাপ্রভুর রাধাভাব তথা পরবর্তী বাঙলা সাহিত্যে তার প্রভাব। চোখ বন্ধ করে প্রায় গোটা বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রধান প্রধান লেখাগুলো বলে যেতে পারতেন। উনি আমায় মহাপ্রভুর সাধনায় সম্বন্ধ-অভিধেয়-প্রয়োজন বোঝাচ্ছেন, আমি মশা তাড়াতে তাড়াতে শুনছি, ইতিমধ্যে সেই গবেষক এলেন। কথা শুরু হল। মহাপ্রভু কোন সালে কোথায় কবে গিয়েছিলেন ইত্যাদি তথ্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। উনি চোখ বন্ধ করে বলছেন, "না না... আপনি যে তারিখটার কথা বলছেন সেই সময়টায় মহাপ্রভু অমুকের বাড়ি কাটোয়ায় তিন রাত কাটিয়েছিলেন, মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল যে!” আমি হতবাক হয়ে দেখছি ওনাকে আর ভাবছি এই আশির ঘরের মস্তিষ্ক এত সক্রিয় থাকে কি করে? ওনার দুই সেবক গিয়ে বই নিয়ে এলো, বই মিলিয়ে দেখা গেল, ওনার স্মৃতি সম্পূর্ণ নির্ভুল।
একটু 'চৈতন্যডোবা' বলতে কি বোঝায় বলে নিই। হালিশহরে মহাপ্রভুর দীক্ষাগুরু শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীর জন্মভিটে। মহাপ্রভু একবার এই গুরুর ভিটে দর্শন করতে আসেন। ভিটের সম্মুখস্থ ডোবায় স্নান করেন। কথিত আছে ভাবে আপ্লুত হয়ে উনি নাকি ভিটের মাটিতে গড়াগড়িও দেন। আঞ্চলিক কোনো কবির ভাষায়, "একি অপরূপ কথা কহনে না যায় / গোলকেরই নাথ হইয়া ধুলায় লুটায় / হায় হায় চন্দনে লেপিত অঙ্গ ধুলায় লুটায়... গোরা যে কাঁদে... আহা হা ঈশ্বরপুরী... হা ঈশ্বর বলে গোরা যে কাঁদে... আপনি কাঁদে গোরা... সকলে কাঁদায়..” ইত্যাদি। সেখানেই এই মঠ অবস্থিত, সেই ডোবাই চৈতন্যডোবা, তার পাশে একটি বৈষ্ণব রিসার্চ সেন্টারও আছে। অজস্র পুঁথিপত্র সেখানে বৈষ্ণব সাহিত্য সম্পর্কিত। এই হল চৈতন্যডোবার ইতিহাস।
তো বাবাজী একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন সেই গবেষকের। মাঝে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন, কি জানিস, তোর সাথে কথা হচ্ছে রসের, এনার সাথে কথা হচ্ছে তথ্যের, এই দুই নিয়েই আমার সংসার। গবেষক হাসলেন, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "মানুষটাকে কেউ চিনল না, এমন অগাধ পাণ্ডিত্য আমি আমার সারা জীবনে দেখিনি।"
আমি কিশোরীদাস বাবাজীর মুখের দিকে তাকালাম, নির্বিকার চিত্তে গবেষকের মুখের দিকে তাকিয়ে শুনছেন, যেন অন্য কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে কথা হচ্ছে।
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সারাটাদিন ওই একটা চৌকিতে কাটাতেন। রাতটা শুধু নিজের ঘরে শুতে যেতেন। একটা সাদা ধুতি, খালি গা, গলায় তুলসীর কণ্ঠী, সদা প্রসন্ন ছোটোখাটো একজন মানুষ। আমার সাথে প্রথম আলাপ, কি করো?
- পড়াই।
- ও মানে আমারই মত ভিখারি।
- আমি বললুম, মানে?
- মানে আর কি, বিদ্যা তো বেচা যায় না, দান করা যায়, তার জন্যে যা পাও সে ভিক্ষাই হল... তাই কিনা?
- বললাম, তা ঠিক।
জিজ্ঞাসা করলাম, বৈষ্ণব ধর্মের সার কি?
হাসলেন, বললেন, খুব সোজা তো, কণ্ঠী পরো, সারা শরীরে তিলক করো, হাতে মালার ঝুলি নাও, আর নিরামিষ খাও...
আমি হতবাক... একি কথা!
উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই হল আধুনিক সময়ের বৈষ্ণব ধর্মের সংজ্ঞা।
আমি বললাম, তবে আসল কথাটা কি?
বললেন, প্রেমের অনুশাসনে মনের নিয়ন্ত্রণ। শুধু বৈষ্ণব ধর্ম কেন বাবা, যে কোনো ধর্মেরই মূল কথা তাই, তবে আজ চতুর্দিকে অবক্ষয়। মানবধর্ম সরে গিয়ে যা চলছে তা হল লোকরঞ্জনের ধর্ম। রাজনীতি থেকে শুরু করে ধর্মগুরুরা পর্যন্ত সেই এক ধর্মে চলছে - লোকরঞ্জন; ওতে গভীরতা কমে, শুদ্ধতা কমে। ভাবের থেকে প্রচারের দিকে ঝোঁক বেশি হয়।
বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওনাকে। আমি দেখেছি কি সুচারুভাবে নিজের কথাকে সাজান। যখন রাণী রাসমণির মূর্তি উন্মোচন হবে, অনেক বড় বড় নেতার সাথে, বক্তার সাথে উনিও বসেছেন। সবার কথাতেই নিজের দিকে ঝোল টানা হল, কিন্তু উনি যখন বলতে উঠলেন, একটা কথাও মহাপ্রভু নিয়ে নয়। বলে গেলেন শুধু রাসমণিকে নিয়ে। ইতিহাসে কি তাঁর অবদান, তাঁর অধ্যাত্ম পিপাসা ইত্যাদি একটার পর একটা বিষয় শুধু রাসমণিকে নিয়ে উঠে এলো। আমি অবাক হলাম ওনার সংযম দেখে। পরেরদিন যখন কথা উঠল এই নিয়ে আমায় হেসে বললেন, ওরা তো আমায় মহাপ্রভুর কথা বলতে ডাকেনি।
পরিচয় ক্রমে স্নেহের সম্পর্কে রূপান্তরিত হল। প্রশ্রয় পেতে শুরু করলাম। নানা বই ঘাঁটার অনুমতি পেলাম। ওনার ব্যক্তিগত সময় বলে কিছু দেখিনি, বয়েসের ভারে কখনও অসুস্থ থাকলে আলাদা কথা। কথার প্রসঙ্গ যে শুধু আধ্যাত্মিকতাতেই, কখনওই নয়। রাজনীতি, শিক্ষানীতি, সামাজিক পটপরিবর্তনে মহাপ্রভুর শিক্ষা, তার সাথে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন। একটি অত্যন্ত দেশ-বিদেশে খ্যাতনামা বৈষ্ণব সম্প্রদায় ওনার এই আশ্রম কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছে বারবার, উনি লড়ে গেছেন। বলেছেন সেটা হলে এটাও ব্যবসাক্ষেত্র হবে, তীর্থক্ষেত্র নয়। হতে দেননি তা। বরং প্রায় প্রাণপাত করে নিজের আশ্রমটাকে বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করে গেছেন সারা জীবন। বহু ভক্ত সমাগম হয় বিশেষ বিশেষ তিথিতে, তাদের শোয়ার, শৌচাদির অসুবিধা হয়, সেই নিয়ে বরাবর চিন্তিত থাকতেন, তার সুরাহা করার চেষ্টা করে গেছেন। কম পয়সায় কি করে বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল গ্রন্থগুলো অপরিবর্তিত রেখে শুদ্ধভাবে ছাপানো যায় তার চেষ্টা করেছেন। বেশ কিছু দুর্মূল্য বই সেই করে আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি।
সারাদিন লোক সমাগমের অভাব নেই। আরেকদিনের আরেকটা ঘটনা মনে এলো। সেদিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, একদল মানুষ হইহই করে ঢুকল। সবাই শ্রমিক সম্প্রদায়ের বোঝাই যাচ্ছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এসেছে। কারণ, অনেকের কণ্ঠী ছিঁড়ে গেছে তাই মালা নেবে। অত্যন্ত গরীব মানুষগুলোর দিকে কি স্নেহ চোখে তাকালেন বাবাজী। বসতে বললেন। গুড় বাতাসা খেতে বললেন। তাদের গা থেকে তখনও কাদার গন্ধ। ওনার সেবককে বললেন এক গাছা কণ্ঠী নিয়ে আসতে। সবাই বেছে নিচ্ছে। কেউ এক ফেরতা কন্ঠী নেবে, কেউ দুই ফেরতা। একজন তরুণী একটা কণ্ঠী নিয়ে একজন তরুণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দে তো আমার গলায় বেঁধে। তরুণীর কণ্ঠের সলজ্জ উক্তি, তরুণের কুন্ঠা নিয়ে আড়চোখে বাবাজী আর আমার দিকে তাকানো দেখে আমার হাসিই পেল। বাবাজী আমার দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গাইলেন, কি কহব রে সখী... পাপ সুধাকর যত দুখ দেল... পিয়ামুখ দরশনে তত সুখ ভেল...
মন্দিরে তখন আরতির বেশে রাধা-মাধব। আরতির প্রস্তুতি চলছে। আমার সামনে এই প্রেমিক যুগল, সেই ভাবে ঈশ্বর প্রেমে আবেশিত বাবাজীর সজল নয়ন... আমার সব গুলিয়ে গেল। বাইরে তুমুল বর্ষা। সে বর্ষা যেন একবিংশ শতাব্দীর না, সে বর্ষা যেন সেই ভাগবতের কবির দেখা বর্ষা, বিদ্যাপতি-গোবিন্দদাস-চণ্ডীদাসের কালের প্রাচীন যুগের বর্ষা। সে বর্ষা যেন জোঁড়াসাঁকোর সেই কিশোরকে ভিজিয়ে শান্তিনিকেতন হয়ে আমাদের এই বাবাজীর আশ্রমে ঝরে পড়ছে।
আমি ফিরব। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এত দেরি করে করে আসিস কেন? কেমন আছিস জানার জন্য আমার মনও তো উতলা হয়... সেই খবরটুকু তো পাঠাতে পারিস...
ভিজে রাস্তা। এখানে সেখানে জল জমে। সন্ধ্যে হয়েছে, চারদিকে আলো আর আলো। হালিশহর শ্মশান পেরোলাম। সামনে সারি সারি মানুষের ভিড়। রামপ্রসাদের ভিটে পেরোলাম। অজস্র মানুষ। আরতির কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। নিঃশব্দ গঙ্গাকে ছেড়ে বাড়ির দিকে হাঁঁটছি। মনে হচ্ছে যেন যুগ যুগান্ত ধরে এমনই হেঁটে চলেছি... কোথায় যাচ্ছি জানি না... কোথা থেকে এলাম জানি না... শুধুই হাঁটছি... কিছু মানুষের ভালোবাসা আর অপেক্ষার পুঁজিকে সম্বল করে পাথেয় বানিয়ে হাঁটছি।
আজ মানুষটা নেই। যা আছে তা একরাশ স্মৃতি। অতৃপ্ত ভালোবাসার স্বাদ। অতৃপ্ত জ্ঞানতৃষ্ণা। কেমন আছি সে জানানোর দায় নেই তোমাকে আজ, তুমি কেমন আছো তাও জানি না। জানি না তুমি তোমার অভীষ্টের চরণ স্পর্শ পেয়েছ কিনা, জানি না তুমি ওপারের কথা জেনেছ কিনা, নাকি সবটাই শূন্য... জানি না...
আমার চলার যেটুকু সময় তোমায় পেয়েছি ধন্য হয়েছি। আমার প্রণাম তোমার পূত, শুদ্ধ, জনকল্যাণে নিবেদিত জীবনের প্রতি। সংসারে আর সব কিছু শূন্য হলেও ভালোবাসা আর অপেক্ষা শূন্য হয় না, এই পরম সম্বল, তুমি জীবন দিয়ে দেখিয়েছো। তোমার চিরকালের রাধা-মাধব আমার ক্ষণকালের সংসারে প্রেমের মূর্তিতে ধরা দিয়েছে। প্রেমের অনুশাসনে জীবনের পরম পথে যাত্রা, সেই তো তীর্থ বাবাজী।
মনোনিবেশ আর কিসে করো মন, করো মনোনিবাস
প্রেম রতন কি এমনি মেলে মন, ডুবে যাও তাঁর সকাশ