বড্ড নিঃশব্দে চলে গেলেন। গতকাল। কিশোরি আমোনকার। যাঁর সুরে মল্লারকে চিনেছিলাম। একটা ঘটনা মনে পড়ছে, ওর কণ্ঠে, 'মন শিব শিব কা শরণ হো' শুনে মা মুগ্ধ হয়েছিলেন। মা তখন ভীষণ অসুস্থ। গানটা কোথাতেও পাচ্ছি না। কিন্তু মায়ের এই ইচ্ছাটাও অপূর্ণ রাখতে চাইছি না। বুঝতে পারছি তাঁর সময় হয়ে আসছে যাওয়ার, তাই হয়ত গানটা অত ব্যাকুল হয়ে চাইছেন।
ইন্টারনেট খুঁজে কিশোরীজির নাম্বার বার করলাম। দুরুদুরু বুকে ডায়াল করলাম। কেউ একজন ফোন ধরলেন। বললাম ওনার সাথে কথা বলা যায় কি না? উনি ফোন ধরলেন, সব শুনলেন। বললেন, ওটা তো ক্যাসেট করা হয়নি, তবে আপনি যদি চান আমার ব্যক্তিগত রেকর্ডিংটা দিতে পারি। কিন্তু কি ভাবে দেবেন? বললেন আমার এক ছাত্রী কলকাতা থেকে আসে, তার সাথে যোগাযোগ করুন। আমি পাঠাচ্ছি ওর হাতে। তাই হল।
আজ ভীষণ মনে পড়ছে সেই গলার আওয়াজ, সেই কথাবলার আন্তরিক উচ্চারণশৈলী। সেবার মল্লার ফেস্টিভ্যালে গাইলেন মিঞা মল্লার আর গৌড় মল্লার। মনে আছে যারা হলে টর্চ দেখাচ্ছিলেন তারাও মুগ্ধ হয়ে বসে পড়েছিলেন মেঝেতে। সারাটা হলে মনে হচ্ছিল বর্ষা নেমেছে পাগলের মত তানে সুরে লয়ে।
আরেকটা ঘটনা শেয়ার করি। ওনার কাছে শোনা। ওনার মা মগুবাই কুর্দিকর খুব বিখ্যাত শিল্পী। একবার হল কি, তখন কিশোরিজীর নাম হচ্ছে বেশ, তিনি খুব উৎফুল্ল হয়ে মাকে বলতে এসেছেন, মা আমার সামনের কয়েকমাস এখানে ওখানে সেখানে প্রোগ্রাম। বলে একটা বেশ বড় লিস্ট শোনালেন। ভাবলেন মা বুঝি জড়িয়ে ধরে আদরটাদর করবেন। ও বাব্বা! হল উলটো। মগুবাই সব শুনে একটু চুপ করে শান্ত স্বরে বললেন, "তো রেওয়াজ করবে কখন?!"
ব্যস, শিক্ষা হয়ে গেল। কতৃপক্ষেরা জানেন ওনাকে ঘর থেকে বার করে বিভিন্ন জায়গায় গাইতে নিয়ে যাওয়া রীতিমত সাধনার কাজ ছিল। রেওয়াজ প্রতিদিনের শ্বাস-প্রশ্বাসের মত ছিল। রবীন্দ্রনাথ অজিতবাবুকে চিঠিতে লিখছেন, ধ্যানে নিজেকে খুঁজে পাই না, পাই বলতে বলতে(লিখতে), ঠিক যেমন বীণায় সুর বাঁধার আগে অনেক ভুলসুর হতে হতে ঠিক সুরটা আসে, ঠিক তেমন।
কিশোরিজী চাইতেন আরো আরো বেশি করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা বাড়ুক। শান্তি আসুক। সরকার আরো তৎপর হোক এর প্রসারে আর শিক্ষায়। জানি না কি হবে। তবে একটা মাইলস্টোন রাখা থাকল। আরেকটা গান দিলাম। আহির ভৈরবের এই বন্দিশ বহুশ্রুত। কিন্তু এমন অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় সুরের সমাধি, যাকে 'ঠ্যাহেরাও' বলে বিস্মিত করে।
প্রণাম রইল, এই অসামান্য শিল্পীর অমর সুরের যাত্রাকে। উপলব্ধিকে