সৌরভ ভট্টাচার্য
8 January 2019
সাতচল্লিশতম জন্মদিন। ব্রেস্ট ক্যানসারের লাস্ট স্টেজ। নম্র, ভদ্র, সমস্ত পরিবারের খেয়াল রাখা মানুষটা সম্পূর্ণ চুপ কয়েকদিন ধরে। সবাই বুঝল সে ডিপ্রেসড। আসন্ন মৃত্যুর সাথে চরম বোঝাপড়া চলছে।
মাঝরাতে হঠাৎ সে তার স্বামীকে ডেকে তুলল। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। এরকম হয় আজকাল। স্বামী তাকে উঠে বসিয়ে, একগ্লাস জল তার হাতে দিল।
জলটা পাশের টেবিলে রেখে সে তার স্বামীর হাতদুটো ধরে বসে রইল মুখের দিকে তাকিয়ে। স্বামী জানে এবার হয়ত সে কাঁদবে। এবার হয়ত সে ভীষণ ভেঙে পড়বে। ছেলে দুটোর খেয়াল রাখতে বলবে। সে মনে মনে এরকম সম্ভাব্য দৃশ্য বহুবার কল্পনা করেছে। সে জানেও তাকে কি কি বলতে হবে এই সময়।
হাতটা ছেড়ে বলল, "তোমায় একটা সত্যি কথা সারাজীবন বলা হয়নি। বলিনি। আমি ভার্জিন ছিলাম না।"
ঘড়ির কাঁটার শব্দ। মুহূর্তে পুরো ঘরটায় যেন কারা এসে কান পেতে দাঁড়ালো। থপ থপ পায়ের আওয়াজ বাথরুম থেকে খাটের কাছ অবধি। ফিসফিস করে কথা বলছে ঘুলঘুলি থেকে কারা। কিচ্ছু শুনতে পারছে না। কানের কাছে একটানা গোঁ গোঁ শব্দ। বাবার চালের কল ছিল। সেই আওয়াজ। মায়ের শিলনোড়া বাটার আওয়াজ। পাতকুয়োতে বালতি ফেলার আওয়াজ, সব শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু কি বলছে ও! না বলেনি এখনও। বলবে।
...আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমার ছোটো কাকা....
মায়ের সিঁদুর পরা মুখ। শাঁখার সাদা রঙে সিঁদুরের দাগ। পায়ে আলতা। ছোটো কাকা... কালো ফ্রেমের চশমাপরা, বিদ্যাসাগরের মত চেয়ারে টানটান পিঠ করে বসা। স্কুলের হেডস্যার ছিলেন। গার্লস স্কুল কি? মনে পড়ছে না। জিজ্ঞাসা করব? থাক। কাল রান্নার মাসির মাইনে দিতে হবে। দুধ আনতে যেতে হবে ভোরে। ছোটোটার টিউশান আছে ভোরে ওকেও ছাড়তে যেতে হবে। এখনই না শুলে মাথা ধরে থাকবে সারাদিন। ছোটকাকা তার মাথার ভিতরে আঙুল দিয়ে কি সরাচ্ছে। ঘিলুর নীচে তার স্ত্রী'র জননাঙ্গ। চেয়ার ছেড়ে উঠে তার খাটের দিকে এগিয়ে আসছে ছোটোকাকা।
খাটটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এই সময়ে তার সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। ওকি কাঁদছে? না শুয়ে আছে কপালে হাত দিয়ে। ওর একটা ব্রেস্ট নেই। অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। রোজ দেখায়। এখন ছোঁয় না আগের মত। কাঁদছে না। বিশ্বাসঘাতক? মিথ্যুক? প্রবঞ্চক? ও নিজেও চেয়েছিল নাকি! শুধুই ছোটকাকা! নাকি পরে ওর মেজকা, ওর দুই পিসতুতো দাদা... অন্ধকার ঘরে সবাই হেঁটে বেড়াচ্ছে।
ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। কখন ঘুমিয়েছে মনে পড়ছে না। ও কোথায়? চমকে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। সাথে সাথেই বাথরুমের দরজায় খট্ করে আওয়াজ হতেই মুখ ফেরালো, একটা নাইটি জড়িয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। সে উঠছে না কেন? কালও তো উঠে ধরেছিল। আজও উঠবে, উঠতেই হবে। মানুষটা কতদিন আর!
নিজেই এসে বিছানায় শুল। চাদরটা গায়ে টেনে তার দিকে সরাসরি তাকালো। কেন এত সরাসরি? চোখ ফিরিয়ে নিল, তার অপমানিত লাগছে। তার ওঠার কথা ছিল।
"তোমায় কিছু বলতে হবে না। আমি তোমায় বলে অনেক শান্তি পাচ্ছি। অন্তত মৃত্যুতে এই ভারটা থাকল না। কি জানোতো, সারা জীবন নিজেকে দায়ী করে গিয়েছিলাম। যেদিন থেকে বিছানা নিলাম, যেদিন থেকে মৃত্যুর জন্য তৈরি হতে শুরু করলাম, সেদিন বুঝলাম জীবনটা ভার্জিনিটির চাইতে অনেক বড়। কিন্তু ভালো হওয়ার কি অকৃত্রিম নেশা আমায় পেয়ে বসেছিল। যেন প্রায়শ্চিত্ত বলতে পারো। কিন্তু কেন বলো? তোমাদের ভগবানের, সমাজের মুখরক্ষা করতে গিয়ে যে জীবনটা বাঁচলাম সেটা তো জীবনের প্রহসন, আমি নিজেই নিজেকে নির্বাসিত রেখে দিলাম সারাটা জীবন। আর আজ এই মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে দেখো আমার সব ভয় চলে গেল। এমনকি তোমাদের সমাজের যে ঈশ্বর, সেও কত ছোটো আমার কাছে, দুর্বল, করুণার পাত্র যেন।"
স্বামী উঠে দাঁড়ালো। বাজারে যেতে হবে, দুধ আনতে হবে, টিউশানে দিতে যেতে হবে, রান্নার মাসিকে মাইনে দেওয়ার আছে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এই প্রথম তার আজ কোনো তাড়া নেই যেন। বাড়ি ফেরারও তাড়া নেই। সব অন্যরকম। কিন্তু শান্তির, ভয় করছে না। কিসের ভয় ছিল?