সৌরভ ভট্টাচার্য
22 January 2017
ভবতোষবাবু একা কৃষ্ণমন্দিরে বসে। বহু পুরোনো মন্দির। সন্ধ্যারতি হয়ে গেছে আধঘন্টা হল। মাঘমাসের প্রথম সপ্তাহ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। তাই আজ তাড়াতাড়ি ফিরে গেছে সবাই।
ভবতোষবাবু ভাবছেন। ভাবতে ভাবতে একা হয়ে যান ভবতোষবাবু। ভাবনাদের গা-হাত-পা থাকে। ভাবনাদেরও ভাবনা থাকে, কষ্ট থাকে, ইচ্ছা থাকে। ভবতোষবাবু জানেন। ভবতোষবাবু একা। যে অর্থে সবাই একা বলে সংসারে, ঠিক সে অর্থে নয়। তার বড় বড় ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী, স্ত্রী – ভরা সংসার। তবু ভবতোষবাবু একা।
ভাবনার রাজ্যটা ভবতোষবাবুর নিজের তৈরী। সেখানে তিনি কাউকে জায়গা দেন না। এমনকি সংসারী ভবতোষবাবুকেও না। তার বয়স এই জুলাইতে আটাত্তর হল, তবু ভবতোষবাবুর মনে হয় সেটা শুধু সংসারী সত্তাটারই। ভাবনায় ভবতোষবাবু এখোনো তরুণ। ভাবনার বয়স বাড়ে না।
দূরে কোথাও মাইকে হিন্দী গান ভেসে আসছে। শ্যামনগরের এই জায়গাটা এখোনো বেশ ফাঁকা ফাঁকা। মন্দির থেকে একটা রাস্তা পিছনে গঙ্গার দিকে গেছে। গরমকালে ভবতোষবাবু গঙ্গার তীরে বসে ভাবেন। ভবতোষবাবু বেশি কথা বলেন না। তিনি জানেন, কথা বললে ভাবনারা আসে না। দেখা দিলেও ধরা দেয় না।
ভবতোষবাবু ঘড়ি দেখলেন, পৌনে সাতটা, মাফলারটাকে আরেকটু শক্ত করে বেঁধে মন্দিরে হেলান দিয়ে বাবু হয়ে বসলেন। তার সামনে কৃষ্ণবিগ্রহ।
ভবতোষবাবুর মনে ঈশ্বর জিজ্ঞাসা সেই কিশোর বয়েস থেকেই। বহু ধর্মগ্রন্থ পড়েছেন। সাধু, সন্ন্যাসী, বাউলের সঙ্গ করেছেন। সব যেন কোথাও ফিকে হয়ে মিলিয়ে গেছে। এখন শুধু তিনি, আর তার ভাবনারা। ভাবনা ভগবানেরও রূপ ধারণ করে। উপদেশ দেয়, ভবতোষবাবু জানেন।
'উঠব কি? নাঃ থাক্।' আজ তার বাড়িতে বড় ছেলের জন্মদিন পালন হচ্ছে। বহু অতিথি। অতিথি বলাটা বোধহয় ঠিক হল না। ছেলের বন্ধুবান্ধবেরাই বেশি। দশটা বাজলে ছাদে ওরা ড্রিঙ্ক করতে উঠবে। ভবতোষবাবু দেখলেন কৃষ্ণের প্রসাদের দিকে একটা টিকটিকি গুটিগুটি পায়ে যাচ্ছে। তাড়াবেন? থাক। ওরা ড্রিঙ্কস করে সারারাত ছাদে দাপাদাপি করবে। ওনার স্ত্রী তনুশ্রী, ঘুমের ওষুধ খেয়ে আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বেন, কেউ কারোর সাথে কথা বলবেন না। এটা প্রত্যেক বছর হয়। টিকটিকিটা সিংহাসনের সামনে কাসার থালায় রাখা বাতাসা চাটছে। চাটুক।
ভবতোষবাবুর হিসির বেগ আসছে। ওনার সুগার। আজ ছ’বছর হল। উঠতেই হবে। কিন্তু ভবতোষবাবু জানেন একবার হিসি করে আসলে আর বসতে ইচ্ছে করবে না। মন্দির বন্ধ হবে ন’টায়। শ্যামল ভট্চায করবে। মন্দিরে মাসোহারা পাওয়া পুরোহিত। প্রায় তার বয়সী। ‘আচ্ছা শ্যামল ভট্চাযের ভাবনারা কি ধুতি পরে আসে?’ ভবতোষবাবু জানেন ভাবনাদেরও পোশাক হয়। শ্যামল ভট্চায যখন মিলের কেরাণী ছিল তখন জামা প্যান্ট পড়ত। একটা খয়েরি প্যান্ট আর একটা কালো প্যান্ট। শ্যামল ভট্চাযের ভাবনারা কি দু’প্রকার? ধুতি পরা, আর প্যান্ট পরা? ভবতোষবাবু হিসি করতে করতে এটাই ভাবছিলেন। শ্যামল ভট্চাযকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? বাড়ী তো পাশেই।
ভবতোষবাবু শ্যামল ভট্চাযের বাড়ীর দিকে এগোলেন। তার ভাবনাগুলো এখন পুরো ল্যাংটো। মাঝেমাঝে ভাবনারা ল্যাংটোও হয়। ল্যাংটো ভাবনারা বুকের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে থাকে। সবসময় বের হয় না। জ্যোৎস্না রাতে বেরোয়।
শ্যামলবাবুর বাড়ীর দরজায় এসে ভবতোষবাবু কলিং বেল চাপলেন। শ্যামলবাবু দরজা খুললেন। গায়ে একটা চাদর জড়ানো। পরনে ধুতি। দুটো ঘর, একটা বারান্দা। শ্যামলবাবুর বৌ অচলা। ছেলেপুলে নেই। শ্যামলবাবু ভবতোষবাবুকে দেখে একটু অবাক হলেন, “দাদা আপনি?”
“তোমার সঙ্গে ক'টা কথা আছে। ঠাকুর না হয় আজ একটু দেরিতে শয়ান দিও।”
শ্যামলবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ ভিতরে আসুন না দাদা।”
দু'জনে গিয়ে খাটে বসলেন। দেওয়ালে বিভিন্ন ঠাকুর দেবতার ছবি। ঘরটার চুন খসে পড়েছে। ভবতোষবাবু শ্যামল ভট্চাযের চোখের দিকে তাকালেন। মাঝে মাঝে চোখ দিয়ে ভাবনাদের হাত-পা দেখা যায়। মুখও দেখা যায়, তবে খুব স্বচ্ছ চোখে। শ্যামল ভট্চায চালাক লোক।
“আচ্ছা শ্যামল, তুমি নারায়ণ শিলা পূজা কর? না কৃষ্ণবিগ্রহ?”
শ্যমল ভ্রু কুঁচকিয়ে বলল, “দুই তো এক দাদা!”
“আচ্ছা শ্যামল, তোমার নারায়ণ শিলা ছুঁড়ে কাউকে মারতে ইচ্ছা করে? এই যেমন ধর কোন টিকটিকিকে?”
শ্যামল ভট্চায ভ্রু কুঁচকে ভবতোষবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমতা আমতা করে কি একটা বলার চেষ্টা করল। ভবতোষবাবু বললেন, “কেউ যদি নারায়ণ শিলা তুলে মারতে যায়, নারায়ণ শিলা আটকায় না। কারো মাথা ফাটালে নারায়ণ শিলার চন্দনে রক্তও লাগে। টিকিটিকির কি লাল রক্ত হয়? জানো শ্যামল, নারায়ণ শিলা আটকায় না। আজ অবধি কোনো হাতকে আটকায় নি। আটকিয়েছে ল্যাংটো ভাবনা। ল্যাংটো ভাবনাই ঈশ্বর। বুকের ভিতর গর্ত খুঁড়ে থাকে। তুমি বুঝবে না। তুমি চালাক লোক। তাই কাঁদতে পারো না। তোমার বুকের গর্তে মাটি চাপা।”
কথাগুলো বলে ভবতোষবাবু হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মন্দিরে এসে টিকটিকিতে খাওয়া বাতাসাটাকে হাতে নিলেন, পকেটে পুরলেন। আজ দেখবেন মানুষ মরে কিসে, পাপে না বিষে?