নর্দমা টানে লোকটা। বড় শহরে থাকে। একটা নর্দমার পাশেই পরিত্যক্ত বাসস্ট্যাণ্ডের শেডের তলায় তিনটে বাচ্চা আর বউকে নিয়ে তার জীবন। কেন এই বাসস্ট্যাণ্ডে বাস দাঁড়ায় না সে জানে না। পর পর কয়েকটা বোমা পড়েছিল, দুটো খুন হয়েছিল এই বাসস্ট্যান্ডটা ঘিরে। চালার একদিকটা উড়ে গেছে। বসার সিটগুলো আর নেই। বসার জায়গাগুলোর পিছনে কাদের যেন ছবি ছিল, সে ছবিগুলোও উড়ে গেছে। চেয়ারগুলো রাখা ছিল যে দুটো মোটা লোহার রডের উপর তার উপর লোকটার বউ হাঁড়ি, কড়াই আর কয়েকটা থালা রাখে। রাতের দিকে রাখে, যখন শুতে যায় সবাই।
বাসস্ট্যাণ্ডের সামনে রাস্তার ওপারে একটা বড় মন্দির। সামনে ঝরণা। সোজা রাস্তাটার দু'পাশে বড় বড় গাছ। গাছের পাতা পড়লে মন্দিরের লোকেরা এসে সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। লম্বা লম্বা ঝাঁটা। লোকটার বউ ভাত গালতে গালতে, ছোটোটাকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে সেই ঝাঁটাটা দেখে আর ভাবে এত বড় ঝাঁটা কোথায় পাওয়া যায়? তার খুব ইচ্ছা হয় তার যখন একটা বড় বাড়ি হবে সে এরকম একটা ঝাঁটা কিনে সারাদিন ঝাঁট দেবে। ক্লান্তি বলে তার শরীরে কিছু হয় না। শরীরের টান বলতে খিদে, ঘুম আর ওর জড়ানো গায়ের তাপ। ক্লান্তি, রোগের বালাই তার নেই। বড় বড় গাড়িগুলো এসে দাঁড়ায়। কত রকম শাড়ি, কতরকম সাজ ছেলেমেয়েগুলোর উকুন বাছতে বাছতে দেখে। কেউ কেউ তাদের পয়সা দেয়, পয়সা দিয়ে মাথায় হাত ছোঁয়ায়, সে যেন ভগবান। তার লজ্জা লাগে। নিজেকে লক্ষ্মীর মত লাগে, ছেলেমেয়েগুলোর বাবা যেন নারায়ণ। না নারায়ণ না, নারায়ণ নেশা করে না। সে পার্বতী আর ছেলেমেয়েগুলোর বাবা শিব।
মন্দিরটা কার বউটা বোঝে না। কোনোদিন ভিতরে যায়নি যদিও। তাদের যেতে নেই। যেরকম কাপড়চোপড় লাগে ওই মন্দিরে যেতে সেরকম কাপড়চোপড় নেই তাদের কারোরই। বড় ছেলেটা একবার ঢুকেছিল। মন্দিরে কুকুর মরে পড়েছিল, পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিল ছেলেটাকে ফেলে দিতে। বড় ছেলে এসে বলেছিল, মন্দিরে একজন মানুষের মূর্তি আছে। কোনো চেনা ভগবান নেই। তারপর একদিন যখন মন্দিরের সামনে একটা দোকান খুলল, সেই দোকানে একটা লোকের ছবি দেখে বড়ছেলে বলল, এই লোকটা। ও নাকি গুরুদেব কোনো।
একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে। লোকটা কাজ থেকে ফিরে এসেছে। ঠিক ফিরে আসেনি, কাজ হয়নি আজ। বউটা বিকালে রাস্তার কলের ধারে বসে জামাকাপড় কাচছে। হঠাৎ হল কি লোকটার পকেট থেকে গড়িয়ে একটা দশ টাকার কয়েন নর্দমায় পড়ে গেল। সবার চোখের সামনে ঘটল ঘটনাটা। সবাই থ হয়ে গেল। লোকটা কোনো কথাই বলল না। বাচ্চাগুলোও কিছু বলল না। বউটাও না। সবাই রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল। বউটার ঘুম আসছে না। সে মন্দিরের সামনের দোকানে গিয়ে বলল, ওগো গুরু, আমায় যদি দশ টাকাটা ফিরিয়ে দাও, তবে আমি রোজ দু'বেলা এখান থেকে তোমায় প্রণাম করব।
সকালে উঠে বউটা দেখল তার মাথার কাছে কি একটা যেন। ঘুমচোখ ঝাপসা। চোখটা রগড়ে দেখল, কেউ তার মাথার কাছে একটা সত্যি সত্যি দশ টাকার কয়েন রেখে গেছে। বউটা সবাইকে ডেকে তুলল। সবাই হতবাক! লোকটা মদ খায়নি বলে অতটা অবাক হতে পারল না। তবু তার মনে হল সে-ও যেন অবাক হল। লোকটা বলল, দেখ এ টাকা যখন ওই গুরু ফিরিয়ে দিয়েছে, তখন ওর হাতেও নিশ্চয়ই নর্দমার নোংরা লেগেছে, এই একটা কয়েন এত্ত বড় নর্দমা ঘেঁটে বার করা কি সোজা কাজ রে? একটা কাজ কর, চল এই টাকাটা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আসি, কাচাকাচি করে নেবে ও, নইলে আবার সিংহাসনে বসতে দেয় কি না দেয়, আমাদের জন্য ও মন্দির ছাড়া হবে, সেটা কি ঠিক? আর ওকে তাড়িয়ে দিলে ও যদি আমাদের সাথে থাকতে আসে, তুই শুতেই বা দিবি কোথায়? তোর ওকে এই টাকার জন্য ডাকাটা ঠিক হয়নি।
বউটা কি ভাবল। সব ছেলেমেয়েগুলো তার মুখের দিকে তাকিয়ে। কি করবে? সবার মুখেই চিন্তা। টাকাটা নিয়ে তারা সবাই মন্দিরের দিকে এগোলো। মন্দিরের গেটের কাছে দারোয়ান আটকে বলল, জানো না এই মন্দিরে ভিখারিরা আসতে পারে না।
লোকটা বলল, "দাদা আপনি তবে এই কাজটা করে দিন আমাদের"... এই বলে সে কয়েনটা দারোয়ানের হাতে দিয়ে বলল, "আমাদের হয়ে তুমি মন্দিরের বাক্সে রেখে দিও, আমাদের একটা মানত আছে"।
দারোয়ান কয়েনটা নিল। কলের জলে ধুলো। তারপর বলল, আচ্ছা, যাও তোমরা, আমি দিয়ে দেব।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে একজন এসে বলল, তোমাদের এখান থেকে উঠে যেতে হবে, এই জমিটা মন্দিরের এখন, এখানে বই রাখার ঘর হবে।
বউটা বলল, আচ্ছা। লোকটাও বলল, আচ্ছা। তারা সব জিনিসপত্র বেঁধে হাঁটতে শুরু করল। বউটা বলল, আমার সেদিন ওকে নর্দমায় নামতে বলা উচিৎ হয়নি বল? লোকটা বলল, টাকাটা পাঠানো হয় তো উচিৎ হয়নি, অপমানে লেগেছে হয় তো। বড়ছেলে বলল, কিন্তু ওই মন্দিরের কেউ কেউ যে বলে আমরা নাকি ভগবান আসলে সবাই, আমি শুনেছি বলতে, গরীবের মধ্যেই নাকি ভগবান। তখন বউটা বলল, সে হয় তো আমাদের চাইতেও যারা গরীব তাদের বলেছে। লোকটা বলল, যে গরীবেরা মদ খায় না তাদের কথা বলেছে হয় তো।
একটা বড় নর্দমার পাশে গিয়ে তারা বসল। এই নর্দমাটাই গতকাল টেনেছে লোকটা। গন্ধ কম। নর্দমার জলের উপরে চাঁদের ছায়া ভাসছে। দশটাকার কয়েনের চাইতেও বড়। বউটার হঠাৎ মনে হল তার পেটের ভিতরটা খলখল করে উঠল, সেই মন্দিরের গুরু যেন তার পেটে জন্মেছে। সে হড়হড় করে বমি করে ফেলল নর্দমায়। লজ্জা পেয়ে বরের দিকে তাকালো। চাঁদের ছবিটা বমির সাথে মিশে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গিয়েছে, কিন্তু ভেসে যায়নি। বউটা লোকটার হাতের উপর হাত রেখে বলল, চল, আমাদের একটা জায়গা হবেই, আমাদের সাথে একজন আছে।
লোকটা বলল, কে?
বউটা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ও।
লোকটা বলল, তুইও নেশা করা শুরু করেছিস নাকি!