Skip to main content

 

সুলতা জানে জীবন সব প্রশ্নের উত্তর দেয় না। সব প্রশ্নের উত্তর দিতেও নেই।

সুলতা চায়ের জল ফোটায়। চা পাতা দেয়। চা ছাঁকে। খদ্দেরকে দেয়। মাঝে মাঝে নিজে চুমুক দেয়। হিসাবে ভুল হলে। বেশি হলে।

দেশ ছেড়ে যখন এলো, সুলতা জানল, অবাক হতে নেই। অবাক হলে জীবন পেয়ে বসে। আরো অবাক করে। সুলতা অবাক হয় না। জীবনের দিকে স্থির চোখে তাকায়। নিরুত্তাপ। জীবন নিরুত্তাপ চোখের সামনে অপ্রস্তুত হয়। সুলতার হাসি পায়। হাসে না।

দুটো ছেলের একজনও সঙ্গে নেই। ঘর মানে কী? সাজানো ইট বই তো নয়। অন্ধকার ঘরে সুলতা তাকায়। অন্ধকার চোখে সয়ে যায়। আলনা, বাক্স, সিংহাসন, দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডার চোখে পড়ে। সিংহাসনে বসে ঈশ্বর ডাকছে, এই সুলতা কিতকিত খেলবি? কেউ খেলে না আমার সঙ্গে। সবাই খালি চায়। টাকাপয়সা, সুখ, স্বাস্থ্য, প্রশ্ন। আমি ক্লান্ত হই। খেলবি সুলতা?

পঁয়ষট্টি বছরের সুলতার ভগবানের এই বায়না ভালো লাগে না। সে নিজেকে বলে, উত্তর করিস না। একটু পর ঘুমিয়ে পড়বে নিজের থেকেই। কত প্রশ্ন, কত অভিযোগ, কত বায়না, কত আবদার, কত ক্ষোভকে এমনিই না তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল সুলতা! আর এতো মাত্র ভগবান! ঘুমোক।

সুলতা সকালে উঠে বাইরে আসে। দরজায় টাঙানো রঙিন শাড়ির পর্দা। ছেঁড়া শাড়ি। পুরোনো শাড়ি। আগে রঙিন শাড়ি পরত। এখন পরে না। সাদা শাড়ি পরে যখন রঙিন শাড়িটার পর্দা ঠেলে ঘরের বাইরে যায়, ভেতরে আসে….কিম্বা ভিতরে যায়, বাইরে আসে… সুলতার মনে হয় জীবনের এদিক ওদিক করছে ডিঙির মত শরীরটার মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে।

বারান্দায় চায়ের দোকান। বারান্দা থেকে নেমেই একটা জবা গাছ আর টগর গাছ। রাস্তার ধারে গাছ। সারাদিন হাজার গাড়ির ধুলোতে আস্তরণ পড়ে যায়। শুতে যাওয়ার আগে সুলতা, চায়ের সরঞ্জাম মেজে, এক ঘটি জল ঢেলে পাতাগুলো পরিষ্কার করে দেয়।

একদিন প্রচণ্ড ঝড় উঠল বিকেলে। কালবৈশোখি। সুলতা একবার ভাবল চায়ের দোকান বন্ধ করে ঘরে চলে আসবে। কিন্তু পারল না। এক ভিখারি আর কুকুরের জন্য পারল না। দুজনেই বারান্দায় উঠে এসেছে। আশ্রয়ের জন্য। ভিক্ষা চাইছে। আশ্রয়ের।

সুলতার কী যে হল। এক মুহূর্তে সেই কোন যুগ পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে আসা, বিয়ে, মা হওয়া, বৈধব্য, ছেলেদের চলে যাওয়া….সব মনে পড়ে গেল। কুকুরটার চোখের দিকে তাকিয়ে, ভিখারিটার চোখের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম মনে হল ঈশ্বর ভিখারির মতও তাকায়!

গলগল করে চোখের পাড় বেয়ে জল নেমে এলো তার। সে শুধু বলল, তোমরা বসো। আমি খাবার আনি।

রঙিন শাড়ির পর্দা সরিয়ে সুলতা সাদা শাড়িটা গায়ে অবেলায় মেঘের অন্ধকারে অন্ধকার ঘরে ঢুকে গেল। কী খাবার আছে সে জানে না। কিন্তু জানে কিছু তো আছেই। জীবন এইটুকু তো তাকে শিখিয়েইছে। কিছু তো থাকেই।