কিছু মানুষ হিমালয়ের মত হন। শুধু মহৎ বলে নন। মাধুর্য আর প্রজ্ঞার এমন মেলবন্ধন যা আজকের দিনে ভীষণ দুর্লভ।
Sukanya Bandyopadhyay এর মা, মানে কাকিমার সাথে আলাপ হওয়ার পর এমন কথাই মনে এল। ওনার সাথে ফোনে কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার। বর্ষীয়ান এই বিদূষী মহিলার সহপাঠী ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার মহাশয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন।
সাহিত্যে ওঁর অসামান্য রসবোধ আমায় মুগ্ধ করে। আমার কোনো লেখার নিরিখে প্রাসঙ্গিক কোনো অন্য সাহিত্যের উদ্ধৃতি, অবশ্যই যা সম্পূর্ণভাবে স্মৃতিনির্ভর - আমাকে বিস্মিত করেছে। প্রণত করেছে আমায় ওনার সুবিশাল পঠন ও সুগভীর মননের কাছে।
এই প্রথম ওনার সাথে সাক্ষাৎ হল। আমার কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখাও করলেন। বলা যায়, দেখা করার সুযোগ দিলেন। সামনাসামনি যেটা চোখে পড়ল, ওনার অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। ললিতে কঠোরে এমন সুষমা যা অনায়াসে পরকে আপন করে নেয়, বয়সের পার্থক্যের দীর্ঘ সংখ্যাগুলোকে ডিঙিয়ে। সময়ের যাত্রা শরীরের কিছু কলকব্জাকেই কাবু করতে পেরেছে শুধু, ওনার অদম্য মানসিক শক্তিকে নয়।
অনেক বিষয়ে কথা হল। খুব আশ্চর্য লাগল যখন আমার কনিষ্ঠ বন্ধু, যে মাষ্টার ডিগ্রী করছে এখন, তাকে জিজ্ঞাসা করলেন কোন কলেজ থেকে কি বিষয়ে সে স্নাতক? এরকম প্রশ্ন সাধারণত এই বয়সের মানুষের মুখে আসে না। অথচ সেই সাধারণ গতের একটা প্রশ্নও করলেন না - বাড়িতে কে কে আছেন, বাবা কি করেন ইত্যাদি জাতীয় একটাও প্রশ্ন না।
ওনার থেকে দূরে আসার পর একটাই কথা মনে হচ্ছে, এই সোজা মেরুদণ্ডী মানুষগুলো কোথায় যেন অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে না? এখন আমরা অনেক চালাক, অনেক বুদ্ধিমান, অনেক ব্যস্ত। তবু কোথায় যেন একটা আঁট নেই। সকালে যা বলি, বিকালে তা বিশ্বাস করি না। রাতে শুতে যাই যে সঙ্কল্পে, সকালে তা ক্ষুদ্র মতলব। আসলে আমাদের অর্থশক্তি, ক্রয়শক্তি, ধূর্ততার শক্তি যতই বাড়ুক না কেন, যতই কৌশলী হই না কেন, মূলে ভাঁটা পড়ে যাচ্ছে, যা কমে যাচ্ছে তা হল - আত্মশক্তি। এই শক্তিটা বাজারে মেলে না, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেলে না। মেলে স্বচ্ছ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। যেটা বহুমানুষের, সেটাই সমাজ, যাতে বহুমানুষের মঙ্গল তাতেই ধর্ম। তা কোনোদিনই স্বার্থচিন্তায়, স্বেচ্ছাচারিতায় নেই। সে চিরকালই ত্যাগে। বৃহতের জন্য ক্ষুদ্রের ত্যাগ। সমাজের জন্য আত্মত্যাগ। যে সমাজের ভুগোল হয়, সে সমাজের কথা বলছি না, যে সমাজের ইতিহাস লেখা যায়, সে সমাজের কথাও বলছি না, যে সমাজে একটা শিশু জন্মালে সোজা মেরুদণ্ডে, মাথা উঁচু করে বাঁচার শিক্ষা দেওয়া হয় সেই সমাজের কথা বলছি।
ওনার মত মানুষেরা সেই সমাজের শেষ প্রজন্ম, আমরা ঐশ্বর্যের ধ্বংসস্তূপ বানাব, না আত্মশক্তিকে জাগাবার শিক্ষাপদ্ধতি খুঁজব, সেটা আমাদের উপর। আজ না হয় কাল, এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে।