Skip to main content

আইস্ক্রিম খেতে খেতে তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে, গালের দিকে তাকাচ্ছে, স্তনের দিকে তাকাচ্ছে। তারা সুখের হিসাব করছে। পুরুষের স্পর্শহীন কোনো নারীর শরীরে ডুবুরি নামাচ্ছে। কতটা পাঁক আড়ালে আছে? কতটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে ফুসফুসের কোণায় কোণায়? অনুকম্পার লেজের আঘাতে শ্যেনদৃষ্টিগুলো অসহায়ের মত ছটফট করছে, সুতীর্থা বুঝছে। তার আজকের এই এলাহি আতিথেয়তার মূলে ভালোবাসা নেই, ঢাল এগুলো। সম্মানরক্ষার। নইলে বাবার অপমান হয়। সুতীর্থার সমস্ত আত্মগত সম্মানবোধের ন্যায়দণ্ড বাবাকে নিয়ে। বাবা সংসারে সম্পদের যুদ্ধে সফল মানুষ নন, কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সার্থক। সুতীর্থা বাবার অসম্পূর্ণ যুদ্ধটায় বাবাকে জিতিয়ে দিতে চেয়েছিল। জিতিয়ে দিয়েওছে। সুতীর্থা কলকাতার একটা নামী কলেজের অধ্যাপিকা। বিয়ে করেনি। সংসারে দায়িত্ব বলতে মা।

       সুতীর্থার সামনে বসে মালবিকা, অজন্তা, বিপাশা, পাপিয়া আর জয়ন্তী। তার কলেজের সহপাঠিকা। বহুদিন পর ফেসবুকে আবার সবার সাথে সবার দেখা। প্রত্যেকেই পঞ্চাশের গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকেই সংসারী ও সুচাকুরে।

       সুতীর্থা বলল, চল বাবার ঘরে বসি।

       মালবিকা বলল, তুই তোর কবিতা পড় কিছু শুনি। ফেসবুকে দিয়েছিস এমন না, নতুন কিছু। মালবিকা মহিলারোগ বিশেষজ্ঞ একজন।

       সুতীর্থার বাবার ঘরটা বেশ বড়। সবাই চেয়ারে, খাটে যে যেমন পারল বসল। কলেজের দিনগুলোতে প্রায়ই আড্ডা বসত সুতীর্থাদের পুরোনো বাড়িতে, উত্তর কলকাতায়। এই বাড়িটা সুতীর্থার বাবার করা। মনোজ বক্সী। ওকালতি করতেন।

       অজন্তা বলল, তুই এখনও রান্নাটা শিখলি না বল?

       সুতীর্থা বাবার কেনা একটা কবিতার বই বাছতে বাছতে অন্যমনস্কের মত উত্তর দিল, না রে।

       সুতীর্থা খাবারগুলো অনলাইনে অর্ডার করে আনিয়েছিল। রান্নার শখ কোনোদিন নেই। এটাকে সুতীর্থা অক্ষমতা বলে ভাবে না, অনিচ্ছা বলে জানে। কিন্তু অজন্তা তা বলতে চায়নি, একটা অপূর্ণতাকে সামনে আনতে চাইছে।

       সুতীর্থা অরুণ সরকারের 'কবিতাসমগ্র' নিয়ে খাটের এক কোণায় বসল। অজন্তাকে বলল, তুই রান্না করার সময় পাস? অজন্তা আর বিপাশা কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী।

       বিপাশা বলল, আমি তো একদমই পাই না রে। আমার শ্বশুর বাড়িতেও এই নিয়ে কোনো ঝুটঝামেলা নেই...

       পাপিয়া বলল, তোর শাশুড়ি উকিল না?

       জয়ন্তী বলল, চুপ কর, ওর শাশুড়ি জজ ছিলেন। আমাদের এনজিও-র সাথে ওনার বেশ ভালো সম্পর্ক। কতবার কত সমস্যায় যে সমাধান দিয়েছেন, তাও বিনা পয়সায়।

       অজন্তা বলল, তোর শাশুড়ির কি এক ছেলে?

       বিপাশা বলল, হ্যাঁ বাবা... পাপিয়াকে জিজ্ঞাসা কর... কি করে যে একটা জয়েন্ট ফ্যামেলিতে থেকে ওই সব বিউটিপার্লার-টার্লার চালাস... আমি তো শুরুতে বিশ্বাসই করিনি... পাপিয়া... বিউটি পার্লার!... হা হা...

       পাপিয়া বলল, কেন? চালাতে পারি না ...

       অজন্তা বলল, ওর কথা রাখ তো... তোর মেয়েটা কোন ক্লাস হল রে?

       ইলেভেন...

       জয়ন্তী বলল, আমাদের মধ্যে একমাত্র সুচরিতাই দুটো ইস্যু নিয়েছে, না?

       অজন্তা বলল, মাথা খারাপ হলে যা হয়...

       আমারটা তো বলছে ডাক্তারী পড়বে... আমি বলেছি মার খেয়ে মরবি রুগীর বাড়ির লোকের কাছে...

       মালবিকা বলল, তা যা বলেছিস... তবে ওকে ডিসকারেজ করার কোনো মানে হয় না কিন্তু...

       অশ্রুর হলই না কিছু না রে মালবিকা?

       না রে, সারা বাড়ি দেখিয়ে শেষে আমার কাছে এলো... বলল... ওমা তুই যে গাইনি আমি তো জানতামই না...

       পাপিয়া বলল, ও চিরকালই ন্যাকার হদ্দ থেকে গেল...

       বিপাশা বলল, আচ্ছা ও ওই ন্যাকা যতীনটাকেই বিয়ে করল না? থিয়েটার-টিয়েটার কি একটা করত না?

       মালবিকা বলল, এখনও করে...

       জয়ন্তী বলল, তোর ছেলে আর্টস নেবে মালবিকা আমি ভাবতেই পারি না... আমি ওর সাথে কথা বলছিলাম... ও বলল, মালবিকা ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

       মালবিকা বলল, আর ছাড় তো... বাবা ইংরেজি সাহিত্যের ভূত ঘাড়ে চাপিয়েছে... সেই থেকে...

       তোর বর অজ্ঞান করার ডাক্তার না রে...? পাপিয়া বলল।

       মালবিকা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, দেখ ন্যাকার কথা...

       বিপাশা একটা কোলবালিশ বুকের তলায় রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে বলল, তোকে কি করে অজ্ঞান করে রে...?

       জয়ন্তী বলল, এর অসভ্যতা আর গেল না... সেই কলেজ থেকে... এ বাবা তুই অমন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছিস কেন?

       সুতীর্থা কবিতার বইয়ে একটা আঙুল গুঁজে সত্যিই চুপ করে বসে শুনছিল।

       পাপিয়া বলল, কি নিয়েই বা কথা বলবে ও... অধ্যাপনা নিয়ে না রাজনীতি নিয়ে?... যা সব পোস্ট দিস বাবা ফেসবুকে আমার তো মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়...

       জয়ন্তী অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, আরে ফেসবুক বলতে মনে পড়ল, এই পাপিয়া, তুই ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে যে শাড়িটা পরে ছবি দিলি ওটা কোথা থেকে নেওয়া রে?

সুতীর্থা আঙুলটা বইয়ের আরো ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। সাড়ে চারটে বেজেছে। মা-কে চা দিতে হবে। সবাই গল্পে মশগুল। সে উঠে রান্নাঘরে গেল কেউ খেয়াল করল না। অথবা খেয়াল করলেও গুরুত্ব দেওয়ার মত অবস্থায় নেই, এতটাই মগ্ন।

       গ্যাসটা জ্বালালো। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে তাকালে একটা হোগলা বন চোখে পড়ে। পরিত্যক্ত জমি একটা, কি একটা কেস চলছে নাকি জমিটা নিয়ে। অথচ চারদিকে কত বড় বড় ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। গ্যাসটা ইচ্ছা করে সিম করে নিল। সময় নিয়ে ফুটুক। মা আজ তাড়া দেবে না। আচ্ছা... সত্যিই কি খুব ব্যতিক্রমী জীবন সে বেছে নিয়েছে?

       তুই উঠে এলি যে?

       মালবিকা এসে দাঁড়িয়েছে।

       সুতীর্থার একটু অপ্রস্তুত লাগল। একটু সামলে নিয়ে বলল, এই মাকে চা দিতে হবে রে।

       মালবিকা গ্যাসের কাছে গিয়ে বলল, আমাদের জলও নিয়ে নে, বেরোব রে এবার...

       সুতীর্থা আরো বাড়তি কাপ জল নিতে নিতে বলল, আমি ভাবলাম এই খেয়ে উঠলি...

       তুই জানিস প্রবালের দুটো মেয়ে...

       এটাও খোঁচা। সুতীর্থা জানে। এই নিয়ে সবার কাছ থেকে আলাদা আলাদা করে সে প্রবালের খবর পেয়েছে। কেন? মানুষ কেন কারোর প্রাইভেসিকে মেনে নিতে পারে না? কেন এত কৌতুহল? সে যদি ছেলে হত?

       সুতীর্থা বলল, জানি। ভালোই তো বল...

       কিন্তু তুই কি পেলি বল? মেসোমশাইয়ের স্বপ্নকে সাকার করেছিস, এটা খুব বড় কথা, কিন্তু তোর নিজের বলে কি হল বলবি?

       সুতীর্থা সরাসরি তাকালো মালবিকার চোখের দিকে। বলল, আমার গোটা একটা স্বাধীন জীবন।

       কিন্তু একাকীত্ব নেই?

       তোর নেই? ও ঘরে যারা বসে আছে, আমার বন্ধুরা, তাদের নেই? সবার আছে। একাকীত্ব আর একা জীবনের মধ্যে পার্থক্য আছে।

       এ সব তোর সাহিত্যের কথা, হ্যাঁ, আমাদেরও একাকীত্ব আছে, কিন্তু তার থেকে বেরিয়ে নিজের গড়া একটা সংসারও আছে... জানি আমি কিছুটা রুড হয়ে পড়লাম হয় তো...

       না ঠিক আছে, আড়চোখে দেখার চেয়ে সোজাসুজি দেখা অনেক ভালো..., সুতীর্থা হাসল... একটু...

       কিন্তু তুইও তো সংসার চেয়েছিলি, নইলে প্রবাল...

       আমি সংসার চাইনি মালবিকা, প্রবালকে চেয়েছিলাম... কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলাম সে দূরেই ভালো... কাছের মানুষটা অন্যরকম...

       পোজেজিভ... আমায় বলেছিলি... মনে আছে...

       হুম... আমার ভালোবাসার আকাশ ভালো লাগে, খাঁচা নয়...

       কিন্তু সংসার বাঁধতে তো খাঁচা আর আকাশ দুইই লাগে বল...?

       যে চায় তার লাগে, আমার লাগেনি, আজও লাগে না...

       মালবিকা সুতীর্থার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। কাঁধে হাত রেখে বলল, তুই সুখী?

       সুতীর্থা বলল, তুই সুখী?

       মালবিকা বলল, আমার মত করে... হ্যাঁ... সুখী...

       সুতীর্থা বলল, আমিও...

       কিন্তু যেদিন মাসিমা থাকবেন না...

       গোটা পৃথিবীটা ফুরিয়ে যাবে না সেদিন... তোরা খাঁচায় থাকতে থাকতে... মোর শকতি নাহি উড়িবার হয়ে গেছিস... বুঝলি... চল, আমি মাকে চা টা দিয়ে আসি, তুই এগুলো নিয়ে ওঘরে যা...

       রাত আড়াইটে। সুতীর্থা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে।

       ঘুম আসছে না খুকু?

       তুমি ঘুমাও নি?

       তুই কবিতার বইটা নিয়ে আয়... অনেকদিন আমরা কবিতাস্নান করিনি...

       বাবার শব্দ...

       হুম... শুধু প্রেম নয়, কিছু ঘৃণা রেখো মনে,

যেমন অনেক বৃক্ষ কোমলাঙ্গ কাঁটা দিয়ে ঢাকে।

আছে লালসার দাঁত, লোভের বিকট জিহ্বা,

প্রভুত্বের লোমশ লাঙুল

ব্যঙ্গের কুঠার, ঈর্ষা, অন্যায়ের সহসা ছোবল

সইবে কেমনে?

শুধু প্রেম নয়, তাই যুগপৎ ঘৃণা রেখো মনে।