একজন সাইকেল চালাতে চালাতে প্রায় রত্নার ঘাড়েই গিয়ে পড়ছিল।
দোষটা রত্নারই। সামনে বিয়েবাড়ির বিশাল বর্ণাঢ্য প্রসেশান, ঝকঝকে চোখ ধাঁধানো আলো, ব্যাণ্ডপার্টির জগঝম্প শব্দ, রাস্তার চারদিকে থিকথিকে ভিড়, এ সবের মধ্যে ভিড় থেকে কিছুটা দূরে, কোলে ছেলেটাকে নিয়ে রত্না দাঁড়িয়ে ছিল। সাইকেল চালকের আর কি দোষ, অন্ধকারে সে দেখবে কি করে, এমনিতেই এত আলোতে চোখ ধাঁধিয়েছে।
রত্না কিছু বলল না। ছেলেটাকে দেখল লেগেছে কিনা। তারও লাগেনি, ছেলেটারও না। ভাগ্য ভালো।
রত্নার চোখ টাটিয়ে আছে গয়না দেখে। এত গয়না সোনার দোকানেই দেখেছে কিনা সন্দেহ। এত এত গয়না মানুষের শরীর জুড়ে!
========
রাতে খাওয়ার পর, ছেলে, বর ঘুমালে, টর্চ জ্বেলে ট্রাঙ্কটা খুলল। দুটো কানের, একটা গলার, আর একটা নাকের। সোনার। ওদের মত অত খাঁটি নয়। তবু এর মধ্যে শুধু কানেরটাই বিয়ের। বাকি তো লোকের বাড়ি কাজ করেই। নিজেই বানিয়েছে।
গয়নাগুলো সব পরল। আয়নাটা ঘরের দেওয়াল থেকে নামিয়ে বাথরুমে এলো। চল্লিশ ওয়াটের বাল্বটা জ্বেলে আয়নাটার সামনে নিজেকে দেখল।
বালতিটা উলটো করে বসল। ভাবল তাকে বিয়ে করতে যদি অমন ব্যাণ্ড নিয়ে আসত নির্মল। সে গ্যারেজে কাজ করে। ভালো মানুষ। মদ খায় না। বাজে খরচ নেই। অন্য মেয়েমানুষে ছুঁকছুঁক নেই। তবু কিছু একটা নেই যেন জীবনে।
মাঝে মাঝেই একটা স্বপ্ন দেখে রত্না। একটা স্টেশানে একা বসে আছে। চারদিকে কুয়াশা। কেউ ডাকছে, গলাটা চেনা, কিন্তু চিনতে পারছে না। সাড়া দিতে যাবে, এমন সময় কুয়াশা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, বলল, যাস না, যাস না, তোর গভীর অসুখ, বাইরে গেলেই মরে যাবি। ডাকটা মিলিয়ে গেল। কুয়াশার ভিতর শুধু ঝিঁঝির শব্দ।
কান্না পেল।
========
তোমার শরীর ঠিক আছে?
বাইরে নির্মল। ছি ছি! এইবার বেরোবে কি করে? গায়ে গয়না, পাগল ভাববে যে!
উপায় কই?
বাইরে এলো। নির্মল আলো আঁধারির মধ্যে তাকে দেখল। তার কানের দুলে রাস্তার আলো পড়ে চকচক করছে। নাকের থেকেও আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
নির্মল কিছু বলল না। হাসল। দুষ্টুমির হাসি। দুটো হাতে, আলতো করে জড়িয়ে ধরল রত্নাকে। কানে কানে বলল, ভীষণ সুন্দর তুমি!
কানের লতিটা আদুরে কামড়ে ধরে আছে নির্মল। অল্প অল্প ভিজিয়ে দিচ্ছে জিভে। রত্না লজ্জায়, আনন্দে, সুখে আর কি এক অজানা বিষাদে নির্মলের কাঁধে মুখ গুঁজে। কিছু বলার নেই। মাথার মধ্যে কুয়াশায় কিতকিত খেলছে কেউ।
নির্মল রত্নার গালটা দু'হাতে ধরে, নিজের ঠোঁটটা সবটুকু আবদার দিয়ে বসিয়ে দিল রত্নার ঠোঁটে।
সব কুয়াশা কেটে গেল। রত্না গয়না মোড়া মেয়েগুলোকে, বউগুলোকে যেন ইছামতীর পাড়ে এনে, নৌকায় উঠিয়ে, বিদায় জানাতে এলো। চাঁদের আলোয় ভেসে ভেসে তারা যাচ্ছে ওপারে। শুধু গয়নাই আছে ওদের। কি যেন নেই।
নির্মল বলল, ঘরে চলো, ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
রত্না নির্মলের মাথাটা সরিয়ে বলল, আরেকটু পর।
রত্নার মনে হল, এখন ঘরে যাবে না। ঠাণ্ডা লাগলে লাগুক। তার ঘরে কি যেন নেই। বাইরে চোখ পড়ে না, ঘরে গেলে পড়ে।
একটা প্যাঁচা ডানা ঝাপটিয়ে এসে বসল ইলেক্ট্রিকের তারে। লক্ষ্মী প্যাঁচা।