ভবতোষ ভটচাযকে চারবার ডেকেও যখন লক্ষ্মী ভটচাজ, যার বিয়ের আগের নাম ছিল লক্ষ্মী চট্টোপাধ্যায়, সাড়া পেল না, রাগে গজগজ করতে করতে ভাজা লুচিগুলো পাড়ার সার্বজনীন কালুর মুখের সামনে মেলে ধরল। কালু তার হৃদয়ের ভাষাকে ল্যাজের দ্রুত সঞ্চালনে মুহুর্মুহু জানাতে জানাতে কোনো লজ্জা না করেই খেতে লাগল।
কিন্তু এ গল্পের গতি সেদিকে তো নয়। এদিকে। মানে ভবতোষ ভটচাযের দিকে। তিনি তার গুরুদেবের ল্যামিনেশান করা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে। বিহ্বল দৃষ্টি। যেন বাথরুমের মগ হারিয়ে গেছে। তিনি এক বালতি জলের সামনে স্থির দাঁড়িয়ে।
=======
সমস্যাটার সূত্রপাত এক স্বপ্নে। ভবতোষ ভটচাজ রোজদিনের মত চারটে রুটি দুধে চটকে, চিনি এক চামচ দিয়ে, খেয়ে, চারটে ঢেকুর তুলে, চল্লিশবার বারান্দায় পায়চারি করে শুতে গেলেন। ঠিক সাড়ে তিনটের সময় নিয়ম মাফিক হিসি পেল। সেটা সেরে এসে, ঠিক দু ঢোক জল খেয়ে আবার শুলেন। আর ব্যস, স্বপ্নটাও শুরু হল।
=======
এবার ভবতোষ বাবু তিনটে দুর্গাপুজোর পৌরহিত্যের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। তিনটে দুর্গাপুজো তো আর একসঙ্গে হয় না, তাই বনেদি বাড়ির পুজো, যেটাও বরাবর করে আসছেন, সেটাই স্থির করলেন করবেন। যদিও দুটো ক্লাব টাকাটা অনেক বেশি দিচ্ছিল। তবু। ওই মায়ের মুখটার উপর কেমন মায়া পড়ে গেছে। কত বছর হল পুজো করছেন। তার ঠাকুর্দার বাবাও করেছেন এই বাড়িতে। এককালে জমিদার ছিল, এই সামন্তরা। এখন সব চাকুরে। তবে পুজোটা এই হিলাইপুরে দেখার মত হয়। এখনও সবাই বলে জমিদার বাড়ির পুজো। অথচ এখন গোটা বাড়ির বেশিরভাগটাই হোটেল। মধ্যবিত্তেরা নকল জমিদারির স্বাদ পেতে আসে।
ধুর, কি সব বলছি। তো স্বপ্ন শুরু হল। ভবতোষবাবু দেবীকে আহ্বান করছেন। কিন্তু মা আর আসছেন না। এদিকে চিল্লানন্দ, টিভি এগারো, বাংলার হুজ্জুতিপার্বণ…. কত চ্যানেল লাইভ টেলিকাস্ট শুরু করে দিয়েছে। ওদিকে মা আর আসছেন না। যতবার কল করছেন, ততবার রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না।
ভবতোষবাবুর বগল ঘামছে। পেটের মধ্যে ভুড়ভুড়ি কাটছে। ফোনটা নিয়ে টয়লেট যাওয়ার নাম করে পিছনের উঠানের পাশে যে সরু গলিটা দীঘির দিকে গেছে সেদিকে গেলেন। এইবার মা ধরলেন। ভবতোষ উত্তেজনায় আর অভিমানে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, মা তুমি কোথায়… এদিকে এরা বলছে এখুনি না শুরু করলে ওদের টি-আর-পি পড়ে যাবে গো… আমার মান সম্মান….
মা বললেন, আরে থাম বাপু….. প্রতিবার তো এই মণিপুরের রাস্তা দিয়ে আসি…. কিন্তু আসার কি উপায় রেখেছিস…. দুটো মেয়ে নিয়ে আসব…. ভয় করে না….. সঙ্গে দুটো ছেলেও তো থাকবে…. কে কি করে ভিডিও করবে… নিশ্চিন্তে আসা যায়?….. তাই ঘুরে আসছি….. দেরি হবে। তুই বোস গিয়ে। মেলা জ্বালাস না।
======
মা এলেন। এসেই ওয়াশরুমে গেলেন। এতটা রাস্তা। ছেলেমেয়েরাও ক্লান্ত। যা হোক, পুজো তো শুরু হল। কিন্তু মা বড্ড অস্থির। মন্ত্র শুনতে শুনতে বারবার বলছেন, কিরে কি বললি, আবার বল… শুনতে পাইনি… আবার আবার বল….
কতবার করে যে মন্ত্র পড়া হল! হঠাৎ মা বললেন, মাইকের আওয়াজটা আরো জোরে কর তো।
ওদিকে টিভির চ্যানেলের লোকজন বলল, না না… সে হবে না…. আমাদের কথা লোকে তো শুনতেই পাবে না… ওই দেখো, তেরোজন সাহেব মেম বসে আছে। ইটালি, জার্মান, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া… কোথা কোথা থেকে সব এসেছে। এটা এখন ইউনেস্কো না হু কার সম্মান পাওয়া উৎসব না? ফুলটুস আন্তর্জাতিক। ওরা "এসেছে শরৎ নিমের পরশ"… কবিতা বলবে...., "শরতে আজ কোন অতিথি এলো আমার ঘাড়ে"… গান গাইবে। এখন মাইক বাড়ানো যাবে না।
মা দুর্গা ডান দিকের দু নম্বর আর বাঁ দিকের তিন নম্বর হাতটা নেড়ে বললেন, তবে গিয়ে ওই বাচ্চাগুলোর আর্তনাদ থামা… যাদের হাত, পা, চোখ, মুখ, শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে গাজা-ইজরায়েলের মারামারিতে… থামা…. আমি শুনছি।
একজন বলল, কিন্তু মা, এই তোমার প্রকৃতিও তো স্ববিরোধে ভরা… এই দেখো কাশবন…. এই যে শিউলির আঘ্রাণ… এই যে শরতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ….. এত শান্তি… সুখ.. আনন্দও তো আছে… খামোখা কোথায় কি হচ্ছে তার জন্যে আমাদের কেন বঞ্চিত করা…
মা বললেন, থাম থাম… নিজের মেয়েটাকে নিয়ে যখন দুর্গা সাজিয়ে কাশবনে নিয়ে গিয়ে টিনের ত্রিশূল আর প্লাস্টিকের মুকুট পরিয়ে ফটোশুট করলি… রিল বানালি… মেয়েটা সদ্য জণ্ডিস থেকে উঠল… সে পারছিল না… তাও শুনলি না। এখানেই শেষ না। তারপর ফটোশুট করে মশার কামড় খেয়ে যখন ডেঙ্গি হল, প্লেটলেট নামতে শুরু করল… তখন তো আমার মন্দিরের সামনে চারবেলা গিয়ে মাথা ঠুকছিলি… তখন কাশের কথা… শিউলির কথা মনে ছিল না!!….
======
মাইক ফুল ভলিউমে দিয়েও লাভ হল না। মা পুরো পুজো শুনলেনই না। আচমকা "আসছি" বলে, চলে গেলেন। সবার মধ্যে জল্পনাকল্পনা শুরু হল। কেউ বলল, তিনি কৈলাসে ফিরে গেলেন। কেউ বলল, তিনি ইউক্রেন গেলেন। কেউ বলল, না না মায়ানমারে কতগুলো লোককে মিলিটারি মারল না ক্যাম্পে.. ওখানে গেলেন। কিন্তু মা গিয়েই বা কি করবেন? মা তো কল্পনার ভগবান না যে চাইলেই জগতকে রূপকথার মত বানিয়ে দেবেন। মা তো আসল ভগবান, তাঁর তো কালের নিয়মে হাত-পা বাঁধাই হবে। ওই কচি বাচ্চাদের দাবাখেলা আর বড়দের দাবাখেলার যা পার্থক্য। বাচ্চারা তো চাইলে রাজামন্ত্রী খুইয়েও খেলে যেতে পারে, ঘোড়া হাতিকে ছক থেকে তুলে ইচ্ছামত যেখানে খুশি বসাতে পারে। কিন্তু আসল ভগবানের কি আর সে উপায় আছে!
একজন উঠে হঠাৎ বলল, আচ্ছা, মা কি এন-আর-আই? আই মিন ভিসা-পাসপোর্ট নিয়ে কোনো ইস্যু হয়নি তো। আসলে আমরা যেখানে থাকি… নিউইয়র্কে.. সেখানে তো এত ইনডিসিপ্লিন কিছু হয় না…. সেই কবে যীশুকে পেরেকে আটকে রাখা হয়েছে…. উনি সেই থেকে ওভাবেই আছেন… একবারের জন্যেও আপত্তি জানাননি….. ওভাবেই প্রার্থনা শোনেন…. আশীর্বাদ করেন…. একগালে চড় মারলে আরেক গাল বাড়িয়ে দেওয়ার শিক্ষা দেন…. সবটাই একটা ডিসিপ্লিন.. মিউচুয়াল টলারেন্সের উপর দাঁড়িয়ে…
হঠাৎ গালে একটা চড় খেয়ে তার কথা আটকে গেল মাঝরাস্তায়। মহাদেব চড়টা ঠাসিয়ে এসে বললেন, একগালে চড় খেয়ে আরেক গাল বাড়াতেই যদি হয় তবে একটা ট্রেড সেন্টার ভাঙলে আরেকটা বানিয়ে ওকে ডাকলি না কেন.. এসো ভাই লাদেন… এটাকেও ভাঙো…. তা না… বিশ্বশুদ্ধ গণ্ডগোল পাকিয়ে….
মহাদেব ক্যামেরার দিকে ফিরে বললেন, তোমাদের মা ভীষণ বিভ্রান্ত তোমাদের নিয়ে…. তিনি বলে পাঠালেন তোমাদের উৎসব চালিয়ে যাও…. পুজোটা তিনি নিতে পারছেন না….. এত এত অপঘাতে মৃত শিশুর আত্মা… ধর্ষণে ছিন্নভিন্ন মেয়েদের আত্মা….. মায়ের আঁচল ধরে ভয়ে ভয়ে ঘুরছে যে মায়ের পক্ষে অ্যাদ্দিন প্যাণ্ডেলে আটকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না….. তবে উৎসব চালিয়ে যাও… মায়ের শুভেচ্ছা আছে।
======
ভবতোষ ভটচায ভাবছেন। সারাদিন ভাবছেন। কোথায় কি একটা গোলমাল হচ্ছে। এদিকে গুরুদেব চোখ খুলছেন না। পুজোতে পুরোহিত লাগে, কিন্তু উৎসবে কি পুরোহিত লাগে? এই প্রশ্নটার উত্তর পাচ্ছেনই না। কার হিত কোথায় হচ্ছে? কি যেন একটা গণ্ডগোল হচ্ছে।