গলায় ক্ষুরটা চেপে ধরল। আমি জানতাম, এটাই হবে। এদিক ওদিক দিয়ে কয়েকজন যাচ্ছে। কেউ তাকাচ্ছে না একবারও। তাদের মধ্যে চেনা পরিচিতও যে নেই, তা তো নয়। তবু সবার ভীষণ তাড়া। নিজের চিন্তার কৌটে নিজে মুখ ডুবিয়ে মাথা নীচু করে হনহন করে হেঁটে চলে গেল। অথচ এদের সাথে রাস্তায়, বাড়ির বসার ঘরে, ট্রেনের হাতলে ঝুলতে ঝুলতে কত কথা বলেছি। গল্প করেছি। পিকনিকে গেছি। কিন্তু এদের সবার চোখের মণি এখন স্বার্থে আটকে। ডাঁয়ে-বাঁয়ে ঘোরার ফুরসৎ নেই যেন।
পকেটে মোবাইল বাজছে। করুণ চোখে তাকালাম। একটিবার যদি তোলার অনুমতি দেয়। দরকারি কলও তো হতে পারে। দিল না। ডানহাতে ক্ষুরটা আরো একটু চেপে গলায় বসিয়ে মাথাটাকে বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরল। আমার রীতিমত কুলকুল করে ঘাম হচ্ছে। পাশে একটা পুকুর। কয়েকটা হাঁস চরে বেড়াচ্ছে। তাদের ছায়াগুলো ছোটো-বড় হতে হতে তাদের ডানদিক-বাঁদিক করছে। কয়েকজন মহিলা পুকুরপাড়ের ওদিকে বাসন মাজছে। খসখস আওয়াজ কানে আসছে। তার সাথে মহিলা কণ্ঠের উচ্চহাস্যর প্রবলতার আধিক্য দূরত্বের কারণে কমিয়ে ক্ষীণ হয়ে কানের ভিতর সেঁধুচ্ছে আমার। চেনা গলা না। আবহটা চেনা। দাঁড়কাক একটা ডেকে যাচ্ছে কোথাও।
মানুষের শেষ ইচ্ছা বলে কিছু হয় কি আদৌ? কত ইচ্ছা মানুষের মনে ফুলঝুরির মত ফুটছে ঝরছে। মনকে আলোকিত করে নিমেষে অন্ধকারে ফেলে রেখে যায় ইচ্ছা। সম্ভাব্যতার বিচারে। বাস্তববুদ্ধি বলে, তাও কি সম্ভব? ব্যস! অমনি ইচ্ছার স্ফুলিঙ্গ বায়ুতে বিলীন। তবু মানুষ মানে ইচ্ছার ফোয়ারা। ইচ্ছার ঝরণা। ঝরণার জলে যেমন সূর্যের আলোর প্রতিফলনে রামধনু, সেই রামধনুতেই মানুষের সুখ। তারপর সেই ইচ্ছার ঝরণা পাথরে পড়ে মাথাকুটে মরুক চাই না মরুক কিচ্ছু যায় আসে না। আমরা ওই রামধনুতেই বাঁচি। হোক অলীক। হোক ক্ষণিক, তবু।
কিন্তু এই চরম মুহূর্তে আমার একি দশা হল? এত দার্শনিক চিন্তা কেন? কত টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলাম? মনে আছে? সব তো কাড়বে? যদি ওর খাই না মেটে? আমি কল্পচক্ষে আমার বিদীর্ণ কণ্ঠনালী নিঃসৃত রুধির প্রবাহ দেখলাম। পুকুরে গিয়ে কুলকুল করে মিশছে। ওদিকে মহিলারা কি ভাবছে? আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের জন্য লাল হচ্ছে জল? না, তারা ভাবছে কোনো সধবা রমণী হয়ত গোঁসা করে তার আলতার শিশি পুকুরে এনে ফেলেছে। তার স্বামী হয়ত অত্যন্ত আধুনিক। সে বলেছে, "কি ওসব ঠাকুমা-দিদিমাদের মতন আলতা পরো? আজ বাদে কাল গোয়া যাচ্ছি হনিমুনে, সুইমিং কস্টিউমের সাথে আলতা পা? ছি ছি, আমার তো মনে শুতে গিয়ে মনে হবে ঠাকুমা, দিদিমার পায়ে চুমু খাচ্ছি! জানো না আমি ফেটিশ!"
রেডিওতে গান চলছে, "গুমসুম হো কিঁউ?" কি বে-আক্কেলে গান মাইরি, গলায় ক্ষুর ধরলে কে পা দুলিয়ে এই বৈশাখের দুপুরে "জোছনা করেছে আড়ি" গাইবে চাঁদ আমার? কিন্তু টাকা?
মাথায় গদাম করে একটা বাড়ি পড়ল। আঁৎকে উঠে চোখ বন্ধ করলাম। বুঝলাম সব শেষ হল। চোখ খুলে দেখি টাওয়েল দিয়ে মাথা ঘাড় পরিষ্কার করতে করতে বলল, "দিন ৭০ টাকা! চুল প্লাস দাড়ি"।
পকেট হাতড়িয়ে দেখলাম, শান্তি, একটা একশো টাকার নোট নিয়েই বেরিয়েছিলাম। জয়গুরু! মাথার সাথে মানও বাঁচল!