যুক্তির উপর যুক্তি সাজিয়ে মানুষের নাগাল পাওয়া যায় নাকি? যুক্তির ফাঁক দিয়ে মানুষ গলে পালায়। মানুষকে ধরতে মানুষ হওয়া লাগে। মানুষ কই?
পাখি গাছতলায় বসে বসে পাতা ঝরে যাওয়া দেখছে। কাঁধের থেকে ঝোলা নামিয়ে রেখেছে পাশে মাটিতে। পিঁপড়ের সার যাচ্ছে। পাখি দেখে বলল, জয় গৌর নিতাই। প্রাণ দেখলেই পাখির গৌর নিতাই বলা লাগে। তার শরীরে যেমন সুখ, দুঃখের প্রাণগঙ্গা, তেমনই এই পিঁপড়ে, ওই গরুতে, পাখিতে, মানুষে। পাখি গাছে হেলান দিয়ে বড় বড় বাড়ি দেখছে। সামনে দোল। মহাপ্রভুর ভোগের আয়োজন করা লাগে। যা জুটাবেন প্রভু।
=======
চন্দনার মনটা ভার। বাইশ বছর বয়েস তার। চারটে বাড়ি কাজ করে। বিয়ে হয়েছে ষোলোতেই। নিজেই কপাল পুড়িয়েছে। কাল ফুচকার দোকানে বসে বসে দেখছিল, তার মতই বয়েস, একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি গায়ে মেয়েটা…কেমন না? লজ্জাও লাগে না। অত মানুষের সামনে অমন উদোম ফর্সা ফর্সা পা। সে নিজেই আঁচলটা বারবার টেনে নিচ্ছিল। তার এই লাল আর হলুদ শাড়িটা ভীষণ প্রিয়। কিন্তু কাল শাড়িটা ভালো লাগেনি, মনে হয়েছে কি একটা ক্যাটকেটে রঙ, দুচ্ছাই!
চন্দনা একা একা হাঁটছে রাস্তায়। দুপুরে খাওয়াটা ভার হয়েছে। এক বাড়ির বৌদির ছেলের জন্মদিন ছিল। বিরিয়ানি রেঁধেছে। অনেকটা খেয়ে নিয়েছে।
ভালো রোদ। চন্দনা হাঁটতে হাঁটতে সামনে দেখল এক গাছের ছায়ায় এক গেরুয়া পরা ধুমসি মেয়ে মানুষ বসে। চোখটা বন্ধ। মরল নাকি মাগী? যাই দেখি গিয়ে।
=====
ডাক্তার বলল কিছু নয়, শরীরে পুষ্টি নেই।
মনো হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটা টোটোতে উঠল। স্টেশান দশটাকা নেবে। খাবে কি? এই আটাত্তর বছর বয়সেও চায়ের দোকানে ফাইফরমাশ খেটে পেট চালাতে হয়। ছেলেটা মরল। বউটা মরল। এখন একা সে। মিল বন্ধ কত বছর। পুঁজি কই? পেট তো আছে।
চশমাটা মুছে আবার চোখে লাগালো। রাস্তাটা বড় খারাপ। পাছাটা বিঁধছে। টোটোতে দুজন আরো, কিশোর। স্কুলে পড়ে। হঠাৎ মাঝরাস্তায় টোটোটা দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, নেমে পড়ুন, টাকা দিতে হবে না, আর যাবে না। চার্জ শেষ।
ছেলেদুটো নেমেই ছুট লাগালো। হাসি পেয়ে গেল মনোর। তারও ইচ্ছা হল ছুটে যায়। আরেকবার বাঁচতে ইচ্ছা করে। আরেকবার বুল্টিকে জড়াতে ইচ্ছা করে। চুমু খেতে ইচ্ছা করে। আদর করতে ইচ্ছা করে।
মনো হাঁটা শুরু করল। প্রচণ্ড রোদ। কিন্তু হাওয়াটা ঠাণ্ডা। রুমালটা বার করে মাথায় দিল। পাতা ঝরে ঝরে রাস্তাটা কি হয়েছে! মনোর কানে এলো দুজন মেয়ে মানুষের গলা। তাকালো ডানদিকে। একটা গাছ তলায় এক মোটা গেরুয়া পরা মেয়েছেলে আর একটা অল্প বয়েসী, সালোয়ার কামিজ পরা, রোগা, কালো। জল আছে ওদের কাছে? তেষ্টা পেয়েছে। শুধু জিভে নয়। মনো মনের হারামিগিরি দেখে অবাক হয়ে যায়। শরীরকে ভেংচি কেটে নিজের আখের গুছানোর ধান্দা বালের।
=====
চন্দনা গাছের কাছে এসে দাঁড়াতেই চোখ মেলে তাকালো পাখি। একগাল হেসে বলল, জয় নিতাইগৌর, এসো মা বসো।
চন্দনার পাখির হাসিটা ভালো লাগল। আপনজনের হাসি। আপনিই গিয়ে বসল। একটু দূরে।
পাখি বলল, আমি তো চোখ বুজে গোবিন্দের ধ্যান করছি। গোবিন্দ পুরীর সমুদ্রে বন্ধুদের নিয়ে খেলায় মেতেছেন। পাড়ে দাঁড়িয়ে আমি বলছি, দাও না গোবিন্দ দুটো ভিক্ষা, আমার গৌরের জন্মদিন যে গো।
তো গোবিন্দ আমার দুই রাঙা পায়ে সমুদ্রের জল ঠেলতে ঠেলতে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। বলল, আমরাও তো আসব তোমার আশ্রমে। তুমি নিতাইকে বলো, সে মন্দিরে আছে, মহাদেবের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। খুঁজে পাও যদি ভিক্ষা পাবে।
আমি বললাম, খুঁজে পাওয়াই তো ভিক্ষা গো… এই বলে এগোতে লেগেছি, মন্দিরে পতাকা বসন্তের হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে, এমন সময় শুনি ঝরাপাতায় কার চরণের আওয়াজ… তাকিয়ে দেখি একি, সামনে দাঁড়িয়ে তুমি রাধারাণী… কৃষ্ণপ্রেমে রঙটা রাঙিয়েছ বেশ গো…
চন্দনার চোখের কোল চিকচিক করে এসেছে। সে লজ্জা পেয়ে বলল, পাগল তুমি একটা… আমি চন্দনা।
পাখি বলল, মনের মধ্যে ডুবে দেখ রে পাগলি, সেখানে কি তুই চন্দনা? সেখানে তুই নিজে কি নিজেকে চিনতে পারিস?
“জল আছে আপনাদের কাছে?”
=====
চন্দনা আর পাখি দু’জনেই চমকে তাকালো, রোগা বয়স্ক একজন মানুষ। ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা মুখটা রোদে লাল হয়ে গেছে। ঘাম নামছে দুই কপালের ধার বেয়ে কুলকুল করে।
পাখি ঝোলা থেকে সবুজ একটা বোতল আর কৌটো থেকে দুটো বাতাসা বার করে মনোর হাতে দিয়ে বলল, এটা খেয়ে খান। তারপর আরেকটা বাতাসা বার করে চন্দনার হাতে দিয়ে বলল, তুইও নে।
মনোর প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। বোতলটা প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল। লজ্জা লাগল। সব সময় সে এরকম স্বার্থপর কেন? বোতলটা ফেরত দিতে দিতে বলল, আপনার সব জল…
আরে ঠিকাছে… জয় নিতাই গৌর হরি দাদা… গোবিন্দের কৃপায় জগতে জলের ভিক্ষা করতে হয় না আপাতত… মানুষ এমনিই দেয়… তবে কদ্দিন দেবে জানি না…
মনো বলল, আপনার আশ্রম কোথায়?
শিমুরালির নেমে যেতে হয়। যাবেন? সামনে উৎসব।
মনো বলল, যেতে ইচ্ছা হয় দিদি, কিন্তু শরীর মন দেয় না। কেউ চাদ্দিকে নেই আর বেঁচে। খাঁ খাঁ করে বুকটা। ডাক্তার বলল শরীরে অপুষ্টি… মনটার দিকে কেউ তাকায় না দিদি…
চন্দনা তাকালো মনোর চোখের দিকে। শুকনো চোখ। ঝাপসা দৃষ্টি। কেউ পুড়ায়নি বলে বেঁচে আছে। বিরিয়ানির ঢেকুরটা উঠল আবার। তেষ্টা পাচ্ছে। দিদি তোমার বোতলটা দাও তো… ভরে আনি…
পাখি বোতলটা দিয়ে দিল।
চন্দনা জানে সামনের বাঁকটা পেরোলে কল। চাপাকল। জল ভরল। খেলো। আবার ভরল। আবার খেলো। আবার ভরল। একটা কোকিল ডাকছে কৃষ্ণচূড়াটা গাছটার ফাঁকে। চন্দনা নকল করে ডাকল। সে ডাকল। চন্দনাও ডাকল। সে আবার ডাকল, তীক্ষ্ণস্বরে। চন্দনা আবার ডাকল। আরো তীক্ষ্ণস্বরে সে জবাব দিল। চন্দনার হাসতে হাসতে দু চোখে জলে ভরে গেল। উবু হয়ে বসে হাসতে হাসতে বলল, আমি কি কোকিল, না রাধারাণী রে পাগল, না চন্দনা?… এত বোকা কেন তুই?
চন্দনা ফিরছে। বাঁক ঘুরতে দেখল লোকটা মাথা নীচু করে বসে। চোখ মুছছে। পাখিদি তার মাথায় হাত বুলিয়ে কি বলছে। প্রথমে যেতে সঙ্কোচ হল। তারপর এগিয়েই গেল। কিসের আড়াল? সবার দুঃখ আছে। লজ্জা কিসের?
পাখিদি বলছে, আপনি আসুন দোলের দিন সকালে। ওখানেই প্রসাদ পাবেন। আসবেন। এই যে রাধারাণী এসো। প্রভু যা জোটান তাই দেব। আসিস রে বোন। মানুষে মানুষে সংযোগ না থাকলে দেখা হয় না। মনে রাখিস। আর মাঝে মাঝে সব সংসার থেকে সরে নিজের মধ্যে ডুবে নিজেকে ডাকিস, কে তুই? বুঝলি।
দাদা, আমি উঠি, আপনি আসবেন। মরণ নিয়ে অত ভাবেন কেন? তার সময় হলে সে আসবে। আর একা কে নয়? ঘুমের মধ্যে যেমন আপনি একা, জেগে থাকলেও একা। টের পাওয়া যায় না কোলাহলে। প্রভু টের পাইয়ে দেন মাঝে মাঝে। তখনই ডাকের সাধ জাগে।
======
পাখি স্টেশানে এসে বসল। চা তেষ্টা পেয়েছে। চায়ের দোকানে গিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ওদিকের প্ল্যাটফর্মে সে দাঁড়িয়ে, বউ, কোলে বাচ্চা। তার বাচ্চাটা মরেছিল। তারপর কি যে হল, সে তাকে ছেড়েছিল, নাকি নিজেই সে ছেড়েছিল বোঝে না… মনে করতে চায় না… মনে পড়েও না।
সে তাকিয়ে আছে তার দিকে… একটা ট্রেন আসুক… বাচ্চাটা মেয়ে… শুনেছে… কি করবে? যাবে ওদিকে, নাকি যাবে না? গেলে কি হয়?
তার ট্রেন ঢুকে পড়ল। পাখির ইচ্ছা করছে না যেতে, ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে একবার কোলে নেয়, একবার তার নরম হাতটা তার গেরুয়াকে ধরুক, একবার বাচ্চাটার গায়ের গন্ধ পাক… পাখির চোখের সামনে সব ঝাপসা… বুকের ভিতর উথাল পাতাল জোয়ার…
শিমুরালি… নামতে হবে… ইচ্ছা করছে না।