Skip to main content

ষোলোই অগাস্ট, সাতাশে জানুয়ারি ইত্যাদি দিনগুলোতে কোনো খবর তৈরি হয় না। বাড়ির দরজার সামনে কয়েকটা ভাঁজ করা পাতায় বিশ্বের নিরানব্বইভাগ খারাপ আর একভাগ ভালো খবর নিয়ে কেউ শুয়ে থাকে না আমার তুলে নেওয়ার অপেক্ষায়। সারাদিন মনে হয়, কে যেন আসেনি, কে যেন আসেনি আজ। কি একটা যেন করা হল না।

       কিন্তু রোজ কি এত খারাপ বিষন্ন খবর পড়তে ভালো লাগে? তা হয় তো লাগে না। কিন্তু ভালোলাগা, খারাপলাগা থেকে অনেক বেশি প্রভাবশালী শব্দ হল – অভ্যাস। অভ্যাসকে ছাড়িয়ে যেতে অসুবিধা হয়। কত যুগের অভ্যাস যেন। এক সময় উবু হয়ে বসে পড়া, তারপর চায়ের কাপ নিয়ে আধশোয়া হয়ে পড়া, এখন রিডিংগ্লাস নাকের ডগায় ঝুলিয়ে পড়া। কিন্তু পড়াটা তো চাই। কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানকার স্থানীয় পেপার অবশ্যই ইংরাজিতে বা হিন্দীতে আমার সকালে চাই-ই। তবে না সেই জায়গাটার সুবিধা অসুবিধা জানার একটা সুযোগ পাওয়া যায়। অত খুঁটিনাটি খবর তো আর আমার বাড়ি বসে পাওয়া যাবে না। কিন্ত কথা হল এইসব জেনে আমার লাভটা কি হবে?

       লাভ? এই প্রশ্নটা বড় ছদ্মপ্রশ্ন। নিজেকে তখন প্রশ্ন করি, কতগুলো লাভ-ক্ষতির হিসাব মিলল এতদিনে? মন এ প্রশ্নে বিরক্ত হয়। তবু জিজ্ঞাসা করি, মন আরো বিরক্ত হয়, ক্ষুব্ধ হয়। নিজের অজ্ঞানতা, নিজের মূর্খামি, নিজের মূঢ়তা এত স্পষ্ট হয়ে যায় তার সামনে যে সে আর সে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না। পালিয়ে যায়। মনের মধ্যেটা দখল করে বসে তখন সবুজ মাঠের মত অলস বৈরাগ্য। হাত পা ছড়িয়ে হাঁটাচলা যায়। কেউ প্রশ্ন করতে আসবে না আর কিছুক্ষণ, এ সব করে লাভ কি!

       সুখ চাই, দুঃখ চাই না – এ আমার প্রতিদিনের সকালের বায়না জীবনের কাছে। কিন্তু জীবনের প্যাকেজে এমন মেনুকার্ড কারোর জন্যে বরাদ্দ হয়নি আজ অবধি। তবে? এর বাইরে এমন কিছু চাইতে পারি কি? হ্যাঁ পারি। খবরের কাগজের পাতা ওল্টানোর মত পাতাগুলো উল্টাতে পারি, জানি সম্পাদক মশায় আমার সাধ-আহ্লাদের কথা ভেবে পরের পাতাটা সাজাননি। কিন্তু এতটা নিরাসক্ত হয়ে থাকা সম্ভব নাকি? এ কথার উত্তর আমরা নিজেরাই জানি। যত দিন যায়, যত চুলে পাক ধরে, তত এই বোধটা স্পষ্ট হয়ে যায় আসলে সংসারে আমাদের অধিকারের ক্ষেত্রটা, নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রটা কত ক্ষীণ। জীবন যত দীর্ঘ হতে থাকে, কুয়াশা যত কাটতে থাকে, সব কিছু চারদিকে যত স্পষ্ট হতে থাকে, বোঝা যায় আমার হাতের নাগালে এক আমার কিছুটা ছাড়া আর কিছুই নেই। মন শিখতে শুরু করে অভিযোগহীন বাঁচা। নিজের অনুভবের সাগরে ঢেউ কমে আসে। স্থির জল। স্থির প্রতিবিম্ব। যদি নিজের থেকে নাড়িয়ে গোল তুলতে যাই, খানিকবাদেই বুঝতে পারি, আয়ুর থেকে বৃথা কিছু সময় গেছে কেবল আমার, কারোর কিচ্ছুটি ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। এমনকি আমার পাশে দাঁড়িয়ে যে ‘আহা-উহু’ করছিল, সেও গোপনে হেসেছিল আমার আত্মম্ভরিতার দাপাদাপিতে। আমরা শান্ত হই, মাথা নীচু করে খবরের কাগজটা তুলে আনি, কম অভিযোগে, কম বিস্ময়ে পাতার পর পাতা উল্টিয়ে যাই। সেদিনের মত পাতা শেষ হয়ে যায় একসময়। শেষ পাতা মুড়ে রেখে বুঝি, আসলে কি ঘটছে কিছুটা বুঝলেও, কেন ঘটছে আমরা কেউ কোনোদিন জানতে পারব না। আবার পরেরদিনের অপেক্ষা। যদিও জানি একদিন আমার দরজায় খবরের কাগজের বাণ্ডিল পড়ে থাকলেও তুলে নেওয়ার জন্য আমি থাকব না। সে না থাকাতে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি কারোর হবে না। শুধু যে যে মানুষগুলো আমার কাছে প্রতিমাসে তাদের কাজের পারিশ্রমিকটা পায়, তাদেরটা দিয়ে যেন যেতে পারি, জীবনে দায় বলতে এইটুকুই। এর বাইরে বড়সড় দেনাপাওনা জীবনে কারোর সাথে আর নেই। জীবনটা এতই অকিঞ্চিৎকর। অথচ মোহের বশে যেন কত বড়, কত মূল্যবান। ভাগ্যে মোহ অনন্ত নয়, মোহভঙ্গের সুখটা যেমন।