Skip to main content

"দিদি তোমায় দিয়ে দিই?" 

    আমার ছোটোভাইয়ের বউ, অঞ্জলি। আমি 'না-ই' বলতাম। কিন্তু অভ্যাসবশত সুগারের ওষুধটা খেয়ে ফেলেছি। এখন কিছু না খেলে শরীরটা খারাপ লাগবে। তাই…

    মায়ের ঘর এটা। এই যে ড্রেসিং টেবিলটা…. মায়ের যে কি মায়া জড়ানো ছিল এর সঙ্গে। মায়ের বাবা তেমন কিছু দিতে পারেননি বিয়েতে। দাদু ওপার বাংলা থেকে এসে গুছিয়ে বসতে না বসতেই মায়ের জন্য সম্বন্ধ আসে। বাবা উকিল ছিলেন হাইকোর্টে। এই কসবার বাড়িটাও বাবারই বানানো। দাদু একটা খাট আর এই ড্রেসিং টেবিলটা দিয়েছিলেন শুধু। কাঁচটা ভালো করে দেখলে মায়ের টিপ আটকানো দাগ খেয়াল করবেন। আমি এখান থেকে টিপ খুলে নিয়ে পরতাম ছোটোবেলায়। আমিও নিজের টিপ লাগাতাম কাঁচে, কলেজে পড়তাম যখন। আমার বাড়িতে করি না। কেন করি না জানি না। কিন্তু ইচ্ছা করে না। কাল বাবু যখন প্রথম সায়ন্তিকাকে নিয়ে এলো, আমার মনে হল আমার একটু মায়ের ঘরে এসে বসা দরকার। বাবু, আমাদের একমাত্র ছেলে। আইটি-তে কাজ করে। ভালো ছাত্র ছিল। আমার স্বামী কলেজে পড়ান, ফিলোজফি। আমার জুলজি অনার্স ছিল। মাস্টার্স করতে করতে বিয়ে হল। ওর জন্যেই মাস্টার্সটা করতে পারলাম। কিন্তু আমায় ওরা পড়াতে দিল না। এমনকি বাড়িতেও না। তখন শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে, তাদেরও সায় ছিল না। কিন্তু মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি পড়াই। কলেজে না হলেও অন্তত স্কুলে। হল না….

    শম্পা রুটি আর ঢ্যাঁড়স সিদ্ধ দিয়ে গেল। শম্পা এই বাড়ি কাজ করে বছর পাঁচেক হবে। খুব মিষ্টি মেয়ে। বর ছেড়ে গেছে। একটা ছেলে আছে বছর আটেকের। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে। আমার এ বাড়িতে আসাটা আমার দুই ভাই কি তাদের বউরা যে পছন্দ করে না, সেটা ও জানে। ওরা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। এক বউ বুটিকের কাজ করে। আরেক বউ বাড়িতেই বিউটি পার্লার চালায়। আমি এলেই ওদের ঝঞ্ঝাট বাড়ে। ভাইরা তো থাকেই না। বড় ভাই মার্কেটিংয়ের কাজ করে। ছোটো ভাইয়ের কিসের যেন ব্যবসা। আমি ভালো বুঝি না। কি টাকা-পয়সার লেনদেন। জীবনের ঝুঁকিও নাকি আছে, ও বলে।

    সায়ন্তিকাকে আমার ভালো লাগেনি। ওর চোখের চাহনিতেও একটা করুণা ছিল। কেন ছিল আমি জানি না। হয় তো বাবু ওইভাবেই আমার কথা বলেছে ওকে। যে ভাবে বললে সহজ হয় তাই বলেছে। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় দূরে কোথায় চলে যাই... একা একা বসে থাকি। কিন্তু আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমার যাওয়ার জায়গা বলতে এখন এই মায়ের ঘরটা। আগে বেলুড়মঠে যেতাম। আজকাল এত ভিড়, এত এত লাইন পড়ে... সেখানেও যেতে ভালো লাগে না। তাছাড়া গুরুমহারাজও দেহ ছেড়েছেন অনেক দিন হল। বেড়াতে যাওয়ার কথা যদি বলেন, সেও আর পারি না। বাবু আর ওর বাবা যত জোরে দৌড়ঝাঁপ করতে পারে, আমি পারি না। হাঁফ ধরে যায়। বাবু তো যা-তা বলে দেয় মুখের উপরেই… "তোমাদের মত মানুষদের ওই বাড়ি বসে সিরিয়ালগুলো গেলাই ভালো…. সারাটা জীবন শুধু গিলেই গেলে, শরীরটা নাড়ানো চাড়ানো না করে এই অবস্থা এখন…."

    ভালোবেসেই বলে। নিজের মাকে অক্ষম দেখতে কার ভালো লাগে! নাকি ওদের নিজেদের অসুবিধা হয় বলে ক্ষোভ থেকে বলে জানি না। আমার স্বামী কিছু বলে না। ওর জীবনে আমার গুরুত্ব এখন খুব কম। আমায় ও সহ্য করে নেয়। ঠারেঠোরে বুঝিয়েও দিয়েছে অনেকবার যে আমায় না হলেও ওর দিব্যি চলে যায়। আমি জানি সেটা। আমায় না হলে সবারই চলে যায় এখন। বরং হয় তো ভালোভাবেই চলে যায়। এখন মাকে খুব মনে পড়ে। যেন বড্ড জীবন্ত। মা বেঁচে ছিলেন যখন তখন এতটা অনুভব করিনি। সত্যিই কি আমিও মাকে বুঝতাম….

    এই যে রামঠাকুরের ছবিটা, এটা মায়ের নিজের হাতে বসানো। মা দীক্ষিত ছিলেন। বাবা নন। মাকে দেখেছি অনেকবার এই ছবিটার সামনে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে। দেওয়ালে সিঁদুরের দাগ লেগে যেত। মা কান্নার পর ভিজে কাপড় দিয়ে দাগটা মুছে দিতেন। এখন এই যে দেওয়ালে হাত বুলাচ্ছি আমি... কোনো দাগ নেই। মা সব মুছে নিয়ে চলে গেছেন। মায়ের কোনো ডায়েরী নেই। মায়ের কোনো চিঠি নেই। তবু মাকে আমি খুব স্পষ্ট বুঝতে পারি এখন। মায়ের যখন তৃতীয় স্ট্রোকটা হল... ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। কাউকে চিনতে পারতেন না। বাবা পাশে বসে হাই ভলিউম-এ খেলা দেখছেন। মা শূন্যদৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছেন। দেখতে দেখতে হিসি করে দিলেন। আয়াদিদি এসে মাকে থাবড়িয়ে সরিয়ে বললেন, ইশারা করতে পারো না?... বাবা আড়চোখে একবার তাকিয়ে বলতেন, আপদ যত…..

    মা কাকে ইশারা করতেন? আমি এখনও বুঝতে পারি না। যারা আমাদের স্বাভাবিক চোখের ভাষা পড়তে পারল না, তারা অসুস্থ অবস্থার চোখের ভাষা পড়তে পারে? জানি না….

    মায়ের মারা যাওয়ার খবরটা এসেছিল ভোরে। আমার চোখে জল এসেছিল আনন্দে। মা মুক্তি পেলেন। আমি খুব কেঁদেছিলাম। আনন্দে। এই ঘরেই….

    মায়ের ছবিগুলো সরিয়ে দিয়েছে এরা। শুধু রামঠাকুরের ছবিটা আছে। ছোটোবউ ভীষণ ধর্মভীরু। এমন মাস নেই যাতে ওর কোনো উপোস নেই। আমায় বলে তো… "দিদি কি করতে যে দীক্ষাটা নিলে... জপ করতে তো দেখিনা কখনো…"

    ভুল বলে না। আমার ভালো লাগে না। চোখ বন্ধ করলেই অন্ধকার। কারা যেন ফিসফিস করে। জপের মন্ত্র বলতে বলতে একা হয়ে যাই। হারিয়ে যাই। কোন অচেনা হাত যেন আমায় জড়িয়ে ধরে। আমার ভালো লাগে না, অস্বস্তি হয়, ভয় ভয় করে। ঠাকুরকে প্রণাম করে উঠে পড়ি। ঠাকুর তো অন্তর্যামী, তিনি বুঝবেন। সমস্যা তো এদের নিয়ে, আর আমার নিজেকে নিয়ে। আমি নিজেকে নিয়ে কি করব বলতে পারেন…..

    আমার অল্প অল্প ঘাম হচ্ছে। বুকটাও চাপচাপ লাগছে। কাঁদতে পারলে ভালো হত। আমি একা থাকি যখন কাঁদি। অকারণেই কাঁদি। ভালো লাগে। স্বস্তি পাই। ওরা বলে আমি যেন সারা সন্ধ্যে সিরিয়ালগুলো গিলি। ভুল বলে। আমি টিভিটার দিকে তাকিয়ে থাকি। টিভির ওরা তো আমার দিকে সরাসরি তাকায় না। এত তাচ্ছিল্য নেওয়া যায় না। এত করুণা হজম করি কি করে? কিন্তু কি করে এসবের শুরু হল বলুন তো…

    এর উত্তর আমি অনেকবার ভেবেছি। আজও পাইনি। আসলে একদিনে তো এ সব শুরু হয় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফাটল ধরে। ধীরে ধীরে চিড়টা বড় হয়। বাইরে থেকে দেখা যায় অনেক পরে। আমি নিজেও কি স্পষ্ট বুঝেছিলাম? প্রথম প্রথম ভাবতাম হয় তো সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। আমার কোনো ব্যস্ততা নেই তাই এরকম মনে হয়। পরে বুঝলাম ঠিক তা নয়। যত ব্যস্ততা আমারই জন্য সবার। যত তাচ্ছিল্য আমারই জন্য। আমার মতামত, আমার ভালো লাগা না লাগা সবটাই অপাংক্তেয়। এমনকি আমাদের বাড়ির বসার ঘরের রঙটাও হল বাবু আর সায়ন্তিকার চয়েসে। আমার বলতে শুধু ঠাকুরঘরটুকু… যেখানে যেতে আমার ভালো লাগে না... শাশুড়ির পাতা সিংহাসন, সেখানে লোকনাথবাবা, কালী, গণেশ, লক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা… আরো কারা কারা সব... আমার প্রাণে ভক্তি জন্মায় না…. অবশ লাগে... শাশুড়ি চোখ বন্ধ করে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন... আমার খিদেতে পেট মোচড় দিতে দিতে অবশ হয়ে যেত…. উনিও কি নিজেকে অবশ করতেই আসতেন?....

    মাথাটা এরকম কেন লাগছে…. দাঁড়াতে পারছি না তো…. বুকটা প্রচণ্ড চাপচাপ লাগছে…. মাথাটা ঘুরছে... শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে…. আমি শুয়ে পড়ছি মায়ের খাটটায়…. চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে…. আমি হিসি করে দিচ্ছি বিছানায়... মায়ের মত…. আমার দিকে ঘেন্নায় তাকিয়ে আছে সবাই… কেউ নেই ঘরে... মায়ের কান্নার সাক্ষী রামঠাকুর ছাড়া….

    আমি মরিনি এখনও। হাসপাতালে। আই.সি.ইউ.-তে। হয় তো মারা যাব। না-ও যেতে পারি। চারদিকে ধাতব শব্দ। এই শব্দগুলো চিনি। বাবা দশদিন আই.সি.ইউ.-তে ছিলেন। ওপেন হার্ট হয়েছিল। বাবা ফেরেননি আর। হয় তো আমিও ফিরব না। আই.সি.উ.-এর জানলার কাঁচের ওপারে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। থরে থরে ফুল। ঝরে যাবে। আমার অনেক কথা, অনেক কথা চাপা আছে বুকে। আমার সঙ্গে সঙ্গে ঝরে যাবে। নার্স আসছে। আমায় ঘুমের ওষুধ দেবে। আমি নাকি ভীষণ ছটফট করি। হাত নাকি বেঁধে রাখতে হয়েছিল মাঝে। দরকার হলে আবার বাঁধবে, বাবু বলে গেল। ভালোবেসেই বলল, কে আর মাকে মেঝেতে মাথা ফেটে পড়ে মরে থাকতে দেখতে চায়?... নাকি দেখলেও কিছু মনে হবে না ওদের…. জানি না… আমি ঘুমাই…. দেখি ঘুম ভাঙে কিনা আর….