একজন বিখ্যাত লেখিকা বাউন্সার নিয়ে বইমেলায় ছিলেন পড়লাম। অনেক কটাক্ষ, প্রশংসা, সমালোচনা ইত্যাদি সবই হল। দেখলাম কিছু কিছু। একজন বাংলায় লিখছেন এবং বহু মানুষ কিনছেন, লাইন দিয়ে সই নিচ্ছেন। এত ভিড় হচ্ছে যে তার জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিতে বাউন্সারের দরকার হচ্ছে, বেশ কথা। এ সব নিয়ে আমার বক্তব্য একটাই, এত মানুষ যে বাংলা বই কিনে পড়ছেন, এত এত তরুণ প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে, এও একটা বড় কথা। লেখার মান ইত্যাদি নিয়ে কোনো আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক এখানে। একটা বড় অংশের পাঠককূলকে 'সস্তা' দেগে, নিজের অত্যন্ত উচ্চ, সুক্ষ্ম রুচিবোধের আত্মতুষ্টিতে ভুগতে আমার অসুবিধা আছে।
কিন্তু আমি ঠিক লেখিকাকে নিয়ে কিছু বলার জন্য এ লেখাটা লিখছি না। আমি ফেসবুক খুললেই, এক ধরণের ভিডিও দেখে এত লজ্জাবোধ করি, সেই নিয়েই দুটো কথা লিখে নিজেকে হালকা করে নিতে চাই।
বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি প্রায়ই বেশ কিছু তরুণ তরুণী রাণু মণ্ডলের বাড়ি যাচ্ছে, খাবার কিনে দিচ্ছে, তাকে নিয়ে নানা 'খিল্লি' করছে। বেশ মজা হচ্ছে। দর্শক বাড়ছে। চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার বাড়ছে। অনেকেই সমালোচনা করছেন। আবার অনেকেই রাণু মণ্ডলের হঠাৎ "সেলিব্রিটি" হয়ে যাওয়ার পরেও নিজের মধ্যে "নম্রতা" ইত্যাদি না রাখতে পারার জন্য যে অধঃপতন, সে নিয়েও লিখছেন। অহংকার পতনের মূল.... একটু নাম হতেই ধরাকে সরা জ্ঞান করা... ইত্যাদি বেশ জ্ঞানগর্ভ সিদ্ধান্তও পড়ছি। ভালো লাগছে। এমন নীতিনিপুণ জাতই তো দরকার।
কিন্তু যাচ্ছে যারা তারা কারা? কি মজাই না তারা একজন অপ্রকৃতিস্থ মানুষকে নিয়ে করছেন। যেমন পাহারাদারের অনুপস্থিতিতে মানুষ চিড়িয়াখানায় পশুদের নিয়ে করে। কেউ লেজ টেনে পালায়। কেউ খাবার দেওয়ার নাম করে কাছে ডেকে মজা করে। এও তেমন। এরা সবাই পশুপ্রেমী। কারণ পশু তাদের আমোদ দেয়। সেরকমই এরাও রাণু মণ্ডলের 'শুভাকাঙ্ক্ষী', কারণ রাণু মণ্ডল তাদের আমোদ দেয়। তাকে উত্তেজিত করে তাকে গালাগাল, 'খিস্তি' দেওয়াতে বাধ্য করে, তাকে লাঠি নিয়ে, ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করতে প্ররোচিত করে মজার ভিডিও হয়। সত্যিই এ সব দৃশ্য উপভোগ্য হয়ে উঠছে বলে তারা বিশ্বাসও করে। কি আশ্চর্য না?
না দেখুন, আমি নীতিপুলিশি করতে বসিনি। শুধু একটা প্রশ্নই মাথায় আসে, রাণু মণ্ডলের অপরাধটা কোথায়? একজন মানুষের বোধশক্তি যদি পুরোমাত্রায় আশানুরূপভাবে কাজ না করে, সে কি তার দোষে? একজন মানুষ হঠাৎ লাইমলাইটে চলে আসার পর নিজের আবেগ, ভাষাকে যদি সমাজের নিক্তি অনুযায়ী উতরাতে না পারে, তবে তার জন্য এতবড় শাস্তি?
রাণু মণ্ডলের বাড়ির সামনে পুলিশ বসবে না। সেটা সম্ভব নয়। রাণু মণ্ডল বাউন্সার রেখে নিজেকে আত্মরক্ষা করবে, সেও সম্ভব নয়। রেগে গেলে বড়জোর গ্রীলটা টেনে দিয়ে, মুখে যা আসে তাই বলে নিজেকে আত্মরক্ষা করে থাকেন এই দেখেছি।
তবে আমরা কোন সমাজে বাস করছি? আমাদের উত্তেজনা, আমাদের রসবোধ, আমাদের শৃঙ্খলাবোধ এমন জায়গায় এসে পৌঁছিয়েছে যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ ছাড়া আমাদের সামলানো যায় আজকের দিনে? আর যদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ না পাওয়া যায় তবে তাকে নিয়ে এমন খিল্লির পর্যায়ে চলে যাবে সব? সে দুর্বল হলে তার বাড়ি গিয়ে হানা, আর সে নাগালের বাইরে হলে তাকে নিয়ে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ মিম বানানো? এবং সেই মিমে সে কতটা অপমানিত হবে এবং সে কি কি করবে ও করবে না সেটাও আমরা ঠিক করে দেব? কি আশ্চর্য না? তুমি যদি জনপ্রিয় হও তবে তুমি আমার আমোদের খেলনা। এসো তোমায় নিয়ে খেলি। কখনও তোমায় সাজিয়ে রথে নিয়ে বেরোই, কখনও তোমার মাথায় ঘোল ঢেলে রাস্তায় ঢাকঢোল বাজিয়ে ফিরি। আমার এসবের অধিকার কে দিল? দেবে আবার কে? আমি জানি আমি সাধারণ তাই স্বাধীন, আমি যা খুশি করতেই পারি। তুমি খ্যাতনামা, তাই তুমি পরাধীন। আর যেহেতু তুমি জনগণের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছ, তাই এ তোমার ট্যাক্স। দিতেই হবে। আমি ঠিক করে দেব সব। তুমি শুধু সেই গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখবে।
কি আশ্চর্য না? ভিড় কখন মব হয়ে যায় জানি না। যেন ভিড় মানেই উচ্ছৃঙ্খলতা। আবার অনুরাগীরাই কখন বাড়ি হানা দিয়ে অপ্রকৃতস্থ অবস্থার শিকারী হয়ে আসবে, তাও জানি না। ভরসা শুধু চামড়াটাকে মোটা করে নেওয়া। আর চোখের পলকটাকে বড় করে নেওয়া।