বিছানা গুছিয়ে রেখে ছাদে চলে গেল। ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। মুঠোর মধ্যে ধরা চারটে ভিজানো ছোলা-বাদাম। মুখের মধ্যে পুরে দিতেই স্বাদ – বাইরের জগতের স্বাদ। এই ছোলা-বাদাম তার নিজের না। বাইরের। তার নিজের মুখের মধ্যে শুধু লালা। অপেক্ষা করেছিল খাদ্যের। দাঁত অপেক্ষা করেছিল। চূর্ণবিচূর্ণ করতে করতে নিজের ধর্ম পালন করছে। দাঁতের একটা সেলফ এস্টিম আছে – স্বমর্যাদাবোধ। জিভ নমনীয়। লালা গোপন ঘাতক। কেউ খাদ্যের বন্ধু নয়। সবাই প্রতিপক্ষ। খাদ্যের চূর্ণ কণাকে শরীরের ভিতর পাঠিয়ে পাঠিয়ে শরীরকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। মানুষের নিজের শরীরে এত প্রোটিন, এত শর্করা, এর স্নেহপদার্থ – তবু মানুষ জগত খেয়ে বাঁচে। মানুষ নিজেকে নিজে খেয়ে বাঁচতে পারে না। জগতের কণা খেয়ে বেঁচে থাকে। জগতকে নিঃশেষ করার সাথে সাথে নিজে নিঃশেষ হতে থাকে ধীরে ধীরে। মানুষ অমরত্ব পেলে পাপী হত। মরণশীল মানুষ তাই পুণ্যের উপরে মুক্তি রেখেছে। পুণ্য এলেই পাপ জন্মাবে। মুক্তির উপরে রেখেছে ভক্তির ইচ্ছা। মুক্তি চাই না, ভক্তি চাই। কিন্তু এই খাদ্য-খাদকের সম্পর্কে ঈশ্বর কোথায় থাকেন?
মুখের বাদাম-ছোলা শেষ। এইবার দুই ঢোক জল খেল। তৃপ্ত শরীর। জগতের কণিকাকে সে গিলে ফেলেছে। কিছুক্ষণের জন্যে সে তৃপ্ত। একটা দোয়েল পাখি একটা পোকা নিয়ে কার্ণিশে বসে ছিঁড়ছে। পাশের বাড়ির ছাদে বেড়াল একটা মুরগীর নাড়িভুঁড়ি নিয়ে এসেছে মুখে করে। কয়েকটা কাক দূরে বসে। আকাশে বকের দল – খাদ্যের সন্ধানে। সারাদিন প্রাণ জগতকে খাচ্ছে। কোনো প্রাণ নিজেকে খেয়ে বেঁচে থাকে না, জগতকে খায়। মানে অন্যকে খায়। নিজেও খাদ্য, নয় কোনো প্রাণীর, নয় সময়ের। সময় সবাইকে গিলে খায়। বিশ্বের বাস্তুতন্ত্রে সময় সব চাইতে বড় বিয়োজক – ডিকম্পোজার। সব কিছুকে শেষ করে দিচ্ছে, প্রাণ-অপ্রাণে পার্থক্য করে না।
মানুষ স্বমেহন করে। তাও অন্যকে কল্পনা করে। মানুষের শরীরের খিদে, মানুষের খাদ্যের খিদের থেকেও বেশি। আদিম খিদে। মানুষ অন্যের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে নিজের সুখের মণিমুক্তা খুঁজতে চায়। আহার নিদ্রা মৈথুন। জীবের স্বভাব। মানুষ শুধু ঘুমাতে যায় নিজেকে নিয়ে। তাই অতিপাষণ্ড আর অতিশোকী – দু'জনেই ঘুম চায়। ঘুমের মধ্যে বেঁচে থাকার সঞ্জীবনী। কিন্তু আহার আর মৈথুন নিজেকে নিয়ে পারে না। সমস্ত জগত খাদ্য আর মৈথুনের আকর্ষণে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। মৈথুন আর খিদে মিটে গেলে সে চায় আমোদ। তাই ভিখারি সিনেমাহলে যায় না, স্টেডিয়ামে বসে হাততালি দেয় না, বা প্রেক্ষাগৃহে বসে ইমনের কড়ি মধ্যমে কাঁদে না। মানুষ খিদের ভিখারি, শরীরের ভিখারি। এই দুই খিদে মিটলে মানুষ আমোদ চায়।
যেহেতু শরীরের খিদে গতকাল রাতে মিটে গেছে, যেহেতু খাদ্য পেয়ে শরীর শান্ত, তাই এখন কিছু করার নেই। মন তুমি কি ভাবছ? শরীর। অর্থ চাই, ক্ষমতা চাই, আরো আরো শরীর চাই। আরো মানুষ চাই। শরীর শুধু কামের জন্যেই না। শরীর দিয়ে আমি দাসত্ব করাই। অনেক মানুষের শরীর, অনেক দাস। আমার অনেক চাহিদা। আমার ক্ষমতা তোমায় দাস করে রাখার। এসো, দাঁড়াও মাথা নীচু করে।
আমার মানুষের পরিচয়, আমি প্রতিভাপূজক। আমার ঘরে মহাপুরুষদের ছবি। তারা মানুষ না। তারা প্রতিভা। বিদ্যাসাগর প্রতিভা তোমার কাছে, মানুষ না। রবীন্দ্রনাথ প্রতিভা আমার কাছে, মানুষ না। মানুষ অসম্পূর্ণ, প্রতিভা সম্পূর্ণ, নিখুঁত। মানুষকে ভালোবাসা যায় না। মানুষকে কাজে লাগানো যায়। মানুষ কখনও শরীর, কখনও আমার একাকীত্ব নিবারক। মানুষ আমার একাকীত্ব নিবারণ করে – আমরা পরস্পর স্ব-করুণার সাগরে ঝাঁপ দিই। আমার সাগর তুমি দেখো; আমার সাঁতার কাটা, ডুবে যাওয়া তুমি দেখো। তোমার ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার আমি দেখব। মনে মনে তোমার সাগর, তোমার কুশলতাকে তুচ্ছ করতে করতে তোমায় প্রশংসা করব। তুমি সত্যি সত্যি বড় হোয়ো না, আমায় প্রশংসা করার সুযোগ দাও, আমায় ঈর্ষান্বিত কোরো না।
মানুষ – আমার খাদ্য, আমার একাকীত্বের ভরসা, আমার অবলম্বন, আমার রাজনীতি, ধর্ম গড়ে তোলার একক। মানুষ তুমি দলবদ্ধ হও, আমি দলপতি হব।
এ সব ভাবতে ভাবতে সে ছাদে ঘুমিয়ে পড়ল। সকাল থেকে বেলা হল। অনেক মৈথুন, অনেক সংক্রমণ, অনেক খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক ভাঙাগড়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে মানুষটা সন্ধ্যেবেলা জাগল। চারিদিক অন্ধকার। তারাদের দিকে তাকিয়ে চাঁদ খুঁজল। নেই। হঠাৎ যেন কি একটা হল। বাতাসে ফুলের গন্ধ। ফুলটা সাদা। নামটা? মনে নেই। সমুদ্রের ধারে, পায়ের তলা থেকে বালি সরে যাওয়ার মত সব ভাবনাগুলো হারিয়ে গেল। যেন তারারা শুষে নিল। মন উদাস। উদাস মন তৃপ্ত মন না। উদাস মন ক্ষুধার্ত না। উদাস মন যেন দুটো তারার মধ্যের নিঃশব্দ ভালোবাসা। যে উদাসী – সেই প্রেমিক। ঈশ্বর তুমি কি উদাসী?
একজন মানুষ একটা ক্রুশ নিয়ে চলেছে। তাকে বিদ্ধ করা হবে। তার পাশেপাশে চলেছে উত্তেজিত, শরীর আর খাদ্যের যাচক জনতা। ব্যঙ্গ আর হুল্লোড়। রক্তের বিন্দু বিন্দু রাস্তায় পড়ছে। ঘাম ঝরে ঝরে পড়ছে। পিঠে চাবুক মারছে একজন ভীষণ শরীর পিপাসী দাস। যে ভয়কে ভালোবেসে দাস হয়েছে রাজার। মানুষটা তৃষ্ণার্ত। জল নেই। ক্ষুধার্ত। খাদ্য নেই। আশ্রয়হীন। করুণাহীন। মহত্বের দ্বীপবাসী। যে মহত্বকে সে নাম দিয়েছে উদাসীনতা। মানুষটা উদাসীন। সে তারাদের গর্জন শুনেছে। নিঃশব্দ রাতের মধ্যে মহাকালের পায়চারী শুনেছে। সে সমস্ত খিদের ঊর্দ্ধে গিয়ে কোনো এক পিতাকে জেনেছে। বিশ্বাসে। যে বিশ্বাস দেয় না, কেড়ে নেয়। যে বিশ্বাস দেয়, সে বিশ্বাসে হাতের মুঠো ভরতে ভরতে ক্লান্ত হয় মানুষ। যে বিশ্বাস কাড়ে সে বিশ্বাসে দিতে দিতে অফুরান সমুদ্র হয় মানুষ – সর্বনাশের আশায় বসে থাকার শব্দ পায়, আর পায় সুর।
মানুষটা সন্ধ্যের আকাশে হাজার হাজার বছর পেছিয়ে গেল। আকাশ জোড়া একটা ক্রুশ দেখল। রক্ত দেখল। আর বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা জন্মালো। আকাশ কিছু ধরে রাখতে জানে না। না মেঘ, না বৃষ্টি, না রঙ, না চাঁদ, না তারা, না সূর্য। বাঁশি বাজাতে ইচ্ছা করল। ছাদ থেকে নীচে নামতে নামতে বাঁশিকে বলল, আসছি, অপেক্ষা করো। সকালে যে বাঁশি নিতে ভুলেছিল, সেই বাঁশিকে আবার রাতের বিছানায় ফিরে পেল। যখন তার বাঁশিতে লেগেছে কানাড়ার কোমল গান্ধার, সে জানে না তখন বাইরের আকাশ ছেয়ে মেঘ। আর ক্রুশে বিদ্ধ সেই মানুষটা একটা মন্ত্র শেখাচ্ছে – ওরা জানে না, ওরা নির্বোধ – ওদের ক্ষমা করো।