চায়ের দোকানের সামনে অল্প অল্প ভিড়। একটা বড় টিনের কৌটো নিয়ে রোগা একটা মানুষ টিউবলাইটের নীচে দাঁড়ালো। কিছু মানুষ আছে না, যারা কথা না বলে থাকতে পারে না, এ-ও সেই গোছের। আমি বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে, তবু সে হেসে হেসে আমার দিকে তাকিয়েই বলতে শুরু করল, দুপুরে খুব খিদে পেল বুঝলেন... অত দুপুরে এই করুনার সময় কে আমার জন্য হোটেল খুলে ভাতের থালা নিয়ে বসে আছে বলুন? আমি এই থেকেই টপাটপ দুটো ইডলি তুলে খেয়ে নিলাম... তারপর কল টিপে একপেট জল... ব্যস... আহ!!!
আসলে ও কাউকেই বলছে না। আমার একটা ফোন চলে এলো, আমি ফোনে কথা বলছি, তবু সে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই সব বলে যাচ্ছে। আরো কি সব বলছে... এবার তার শ্রোতা সামনের ভ্যানওয়ালা, যার ভ্যানে কয়েকটা বেগুন আর লাউশাক। ভ্যানওয়ালার বাংলায় হিন্দির টান। বয়েস হয়েছে। শরীর দুমড়েছে। এখনও নিংড়ে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজছে। একটু দূরে বসে ওর গিন্নী, এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। যেই না ইডলিওয়ালা বলল, দুটো ইডলি দিই, চায়ের সঙ্গে খাবেন... অমনি পাশ থেকে খিলখিল হাসির শব্দ। উবু হয়ে বসে এক বয়স্কা মানুষ। মাথায় আঁচল টানা। গায়ে একটা হালকা চাদর। সব্জী বিক্রেতা মাথা নেড়ে বলল, আমি ওসব খাই না।
উত্তরের আশা কে করে... ততক্ষণে রোগা মানুষটা তার সরু সরু আঙুল দিয়ে বেগুন টিপে দেখছে। উবু হয়ে বসা সব্জীওয়ালার বউ বলল, নিয়ে নাও... আমার ক্ষেতের আছে....
সব্জীওয়ালা বলল, আমার তো লকডাউনে হাস্পাতালের কাজটা গেল... কি করব... বাড়ির সামনেই এগুলো লাগিয়ে কিছু কিছু হয়ে যায়....
ইডলিওয়ালা বেগুন কিনল না। পাশের রেলের কারখানা থেকে কয়েকজন বড়মানুষ বেগুনের দর করছে। সে তার ইডলি নিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালো.... বেগুন দর করা হাত, চোখ যদি ইডলি চাখতে চায়...
তৃষ্ণার্ত উৎসুক তিন জোড়া চোখ কারখানার বড় মানুষগুলোর দিকে.... বেগুন, লাউশাক আর ইডলি তো নিমিত্ত মাত্র... খিদে...
কেউ কিছু কিনল না। কোন বাজারে নাকি এর চাইতেও সস্তা বেগুন। আর কার বাড়ির সামনের লাউশাক নাকি এর চাইতেও সবুজ।
ইডলিওয়ালা দুটো বেগুন কিনল। বলল, আসি, যদি রাণাঘাট লোকালটা পেয়ে যাই, ওখানে কাজ করে সোজা বাড়ি.... ফুলিয়া।
বেগুনগুলোর উপর স্ট্রিটলাইটের সাদা আলো পড়ে গা চকচক করছে। লাউশাকগুলো জড়াজড়ি করে শীতের সন্ধ্যেতে। উবু হয়ে সব্জীওয়ালা বসে তার স্ত্রীর কাছে। কি বলছে জানি না। নীচু গলায় বউ কিছু বলছে, সব্জীওয়ালা শুনছে। চায়ের দোকানে ভিড় অল্প বাড়ছে, ভাঙছে। স্তূপাকার ভাঙা চায়ের ভাঁড়ে খাবার খুঁজছে কয়েকটা চেনাজানা কুকুর।
ভ্যানের সামনে একজন মহিলা দাঁড়ালো। লাউশাকের দাম জিজ্ঞাসা করছে। এবার সব্জীওয়ালা বসে, স্ত্রী উঠে বলল, কতটা নেবেন....