জমা জল নিয়ে অশান্তি। বাড়ির সামনেটায় বৃষ্টি হলেই জল জমে। ব্যাঙ লাফায়। কেঁচো চলে আসে। সাপও যে আসে না তা নয়। আগে ফাটা টালি দিয়ে জল পড়ত, সেটা যে পড়ে না, এই রক্ষে। মারা যাওয়ার আগে একটা পাকা ছাদ তুলে দিয়ে গেছে।
সামনের মাসে বোষ্টুমের কাজ। বাৎসরিক। টাকা হাতে তেমন নেই। তবু ওতেই বৈষ্ণব সেবা নমো নমো করে করে ফেলতে হবে। কিন্তু একি বৃষ্টি রে বাবা। আশ্বিন মাসে এমন বৃষ্টি! কি সব অনাসৃষ্টি যে হচ্ছে। ওদিকে ট্রেন বন্ধ। কয়েকটা জায়গায় ভিক্ষা করতে যেতে পারলে বোষ্টুমির চলে যায়। কল্যাণী, কাঁচরাপাড়া, হালিশহর, নৈহাটি – এই কয়েকটা জায়গা বোষ্টুম যেত। শেষ কয়েক মাস বোষ্টুমি গিয়েছিল। একা মানুষ অত ঘুরত না। কিন্তু এখন? এই পায়রাডাঙায় ক’টা বাড়ি ঘুরবে? মুখ বেশি চেনা হয়ে গেলে লোকে ভাবে রোজ আসছে। ঘুরে ফিরে গেলে লোকে বিরক্ত হয় না। তাছাড়া বোষ্টুমের গলায় সুর ছিল। বোষ্টুমি জানে তার গলাতে সুরের থেকে ঝাঁঝ বেশি। তাই গানের চেষ্টা করেনি কোনোদিন। “জয় হরিবোল, রাধাবোল, জয় গৌরনিতাই হরিবোল” বলে হাঁক পেড়ে গৃহস্থের দরজায় দাঁড়ায়। কেউ তাড়ায়, কেউ দেয়।
আজও সকাল থেকে বৃষ্টি। সারা উঠোন জলে একাকার। একটা নারকেলের মালায় চা নিয়ে বোষ্টুমি বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে। বোষ্টুমের জন্য কান্না পায় না আজকাল। বুকের মধ্যে হল্কা লাগে একটা। ফাঁক তৈরি হয়ে গেছে বুকের ঠিক মাঝখানে একটা। বোষ্টুমের এই এক বছরের কাজটা করে দিলে আর করবে না ঠিক করে রেখেছে মনে মনে। বাকি কটা দিন এমনিই কাটিয়ে দেবে কিম্বা হয় তো অন্য কিছু.....
বোষ্টুমির বাঁদিকে ঠাকুর। রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। কৃষ্ণনগর থেকে কেনা। চন্দনের গন্ধ আসছে ভিজে বাতাসে মেখে। বোষ্টুমি দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে সে যুগলমূর্তির দিকে তাকিয়ে। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। সাদা কাপড়ের আঁচলে চোখটা মুছে আবার তাকাচ্ছে। রাধাকৃষ্ণও তার দিকে তাকিয়ে আছে। সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডর দিকে যে চোখ অপলক তাকিয়ে থাকে, সেই জোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। বোষ্টুমি শাস্ত্র পড়েনি। বোষ্টুম পড়েছিল। কি করে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হল বোষ্টুম জানত। পড়েছিল। রাধাশক্তি কেন হ্লাদিনী শক্তি বোষ্টুম ব্যাখ্যা করত শিষ্যদের কাছে। বোষ্টুমি রান্নাঘর থেকে শুনত। বোষ্টুমি দীক্ষার জোগাড় করত। বড়লোকের বাড়ির কেউ দীক্ষা নিলে খুব খুশী হত বোষ্টুমি। গেলবার পুজোর আগে একটা সাবান কিনেছিল বোষ্টুমি, দামী সাবান। খড়দা থেকে একটা বড়লোক পরিবার দীক্ষা নিয়ে গেল যে। বোষ্টুমি জপের মালা, কণ্ঠীমালা গেঁথে দিত বোষ্টুমের শিষ্যদের জন্য। বোষ্টুমি তো নিজেও শিষ্যা বোষ্টুমের।
চা’টায় চিনি নেই। চিনি শেষ। রসিকের দোকানে এমনিতেই অনেক বাকি। বোষ্টুমকে শ্রদ্ধা করত, তাই দেয়। কদিন দেবে? বোষ্টুমি রাধাকৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে। মোহ লেগে যাচ্ছে। পিঁপড়ে যেভাবে বাতাসার উপর বসে, সেভাবে তার মন সে যুগলমূর্তির দিকে তাকিয়ে। বুকের ভিতর থেকে শিরশিরানি কান্না উঠছে। কাঁদছে বোষ্টুমি, কিন্তু মনের মধ্যে সুখও জমছে। শান্তির সুখ। তার দিকে তাকিয়ে যুগলমূর্তি। প্রান জুড়ানো দৃষ্টি। মন মাতানো সুখ।
আজ আর ভিক্ষা করতে যাওয়া হবে না। বৃষ্টির মধ্যে লোকে বিরক্ত হয়। মানুষের বিরক্তি দেখে দেখে এক এক সময় নিজের উপর ঘেন্না ধরে যেত বোষ্টুমির। এখন সয়ে গেছে। বোষ্টুম বলত অপমান সহ্য করা সাধনা। অনেক শহরের চায়ের দোকান চেনে বোষ্টুমি। কত সকাল শুধু চায়ের দোকানে দুধ চা আর দুটো বিস্কুটেই কেটে গেছে। বাড়ি ফিরে বিকেলে ভাত চাপিয়েছে। চায়ে খিদে মারে। চা গোবিন্দের দান, গরীবের পেটের দিকে জন্য বানানো - বোষ্টুম বলত। বোষ্টুমি চায়ের দোকানে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে বড় মানুষদের গল্প শুনত। সে শুনেছে মানুষ মুখেই যত গরীবের দুঃখকষ্ট নিয়ে আলোচনা করে, আসলে গরীব সামনে এসে দাঁড়ালে তাকে দূর ছাই-ই করে। বোষ্টুম বলত রাজনীতি দলাদলি নিয়ে আলোচনা করা নাকি বড়মানুষদের দরদ-বিলাসিতা, গরীব তো ছুতো মাত্র। সে বিলাসিতা ভাতের ফ্যানের মত। দরকার মত সে ফ্যান গেলে নিলে, তারপর ঝরঝরে ভাত টেবিলে রাখা। বোষ্টুম গান্ধীজীর কথা বলত, সেই নাকি গরীবদের কথা বুঝত। বোষ্টুমি গান্ধীজীর ছবি দেখেছে। গান্ধীজীকে দেখেনি। বোষ্টুম দেখেছে নাকি ছোটোবেলায়।
নারকেলের মালাটা শূন্য পড়ে আছে পাশে। বোষ্টুমির চা খাওয়া শেষ। হাতটা গ্লাসের জলে ধুয়ে, হাতধোয়া জল নারকেলের মালায় ফেলে, বোষ্টুমি জপের মালা নিয়ে বসল। আজ ঠাকুরঘরে বসবে না, এইখানেই বসবে। বৃষ্টিতে বাইরেটা ঝাপসা হয়ে আছে। আরো ঘন কালো মেঘ করে এলো। চারদিকে আরো অন্ধকার। যেন এখনি সন্ধ্যে হবে।
বোষ্টুমির মনে হল কৃষ্ণ যেন চোখের পাতা ঝপকালো। বোষ্টুমির মনে হল রাধা যেন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। বোষ্টুমির বুড়ো আঙুল বেয়ে চলেছে নামের ধারা। একটু দূরে আলনার উপর রাখা বোষ্টুমের সাদা ধুতিগুলো, চাদর। বোষ্টুমি সপ্তাহে একবার করে কেচে রাখে। একতারাটাকেও একটা গেরুয়া চাদরে ঢেকে রেখেছে। বোষ্টুমের বিছানায় শোয়ানো আছে। বোষ্টুম গেরুয়া রঙ পছন্দ করত না, সে বলত, ওতে মনে অহংকার হয়। বোষ্টুমি তাও গেরুয়া দিয়েই তার একতারাটাকে ঢেকেছে। হোক অহংকার। বোষ্টুম তো তার অহংকারেরও বেশি, তার গুরু। গুরু আর অহংকার এক জায়গায় থাকে বুঝি? এ তত্ত্ব বোষ্টুম না বুঝুক, বোষ্টুমি বোঝে।
কৃষ্ণের চোখে দুষ্টু হাসি। বোষ্টুমিকে যেন কি একটা বলতে চাইছে সে। রাধা ইশারা করল। বোষ্টুমি বুঝল। সে উঠে গিয়ে বোষ্টুমের ঘরে গেল। খাটটাকে প্রণাম করল মাথা ছুঁইয়ে। তারপর গেরুয়া মোড়া একতারাটা হাতে নিল। আবার বারান্দায় এসে বসল।
একতারাটায় একটা টং করে আওয়াজ করতেই অবাক হল বোষ্টুমি, একটুও সুর নেমে যায়নি তার থেকে? কি করে হয়? একতারাটা গালে ঠেকালো। গরম গা। যেন এক্ষুণি বাজিয়ে গেছে বোষ্টুম। বোষ্টুমি আবার ঠাকুরঘরের দিকে তাকালো। উৎসুক দৃষ্টিতে রাধামাধব তার দিকে তাকিয়ে, কি উৎফুল্ল তাদের মুখ। যার দৃষ্টি সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে সে আজ এত কাছের কি করে হল? বোষ্টুমি খুব নীচু স্বরে গান গাইতে শুরু করল। বেশি পদ সে জানে না। কয়েকটা পদই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গায়, একা একা, মনে মনে। বোষ্টুমি গাইছে – “মাধব বহুত বিনতি করি তোঁহে...দেহি তুলসী তিল এ দেহ সমর্পিনু, দয়ানিধি, না ছোড়বি মোহে...”...
অল্প অল্প খিদে পাচ্ছে বোষ্টুমির। কিন্তু রাধামাধব যে তন্ময় হয়ে শুনছে তার গান। বোষ্টুমির খিচুড়ি আর বেগুনী খেতে ইচ্ছা করছে... “কিয়ে মনুষ-পশু পাখি কিয়ে জনমিয়ে, অথবা কীটপতঙ্গ, করম বিপাকে গতাগতি পুনপুন মতি রহু তুয়া পরসঙ্গ”...। বোষ্টুমির ইচ্ছা করছে বোষ্টুমের পাতে গরম খিচুড়ি বেড়ে দিতে, সাথে পাঁপড় ভাজা। সেই গরম খিচুড়ি আঁচলের বাতাস দিয়ে ঠাণ্ডা করে দিতে... হাপুস চোখে কাঁদছে বোষ্টুমি... কৃষ্ণ বসেছে খেতে, রাধা গরম খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছে তার পাতে...কৃষ্ণের বাঁশিটা পাশে রাখা... রাধা বাতাস করছে... গানের শেষ কলিগুলো গাইতে হবে যে বোষ্টুমি... কিন্তু এমন বানডাকা কান্না কোথায় লুকিয়ে ছিল তার বুকে?... ”ভনয়ে বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর তরয়িতে ভবজল সিন্ধু, তুয়া পদপঙ্কজ করি অবলম্বন এক তিল দেহ দীনবন্ধু”...
বোষ্টুমি উপুড় হয়ে শুয়ে তার ঠাকুর ঘরের সামনে... পাশে শোয়ানো একতারা... জপের মালা জড়িয়ে আছে আঁচলের সাথে লেগে... বোষ্টুমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে... আজ সর্বস্ব শেষ করে দেবে ভেবেছিল... ধুতি গলায় জড়িয়ে ঝুলে পড়বে... ভোররাতে এমন ভাবনাই ভেবেছিল... এমন নিঃস্ব জীবন রেখে কি হবে... দরিদ্র ছিল সে, কিন্তু ভিখারি তো ছিল না, বোষ্টুম চলে গিয়ে তাকে যে ভিখারি করে রেখে দিল... এমনই সে ভেবেছে সারা বছরটা... কিন্তু আজ সব গোলমাল হয়ে গেল... আজ তার খিদে পেল... আজ তার গলায় সুর জন্মে গেল... কি করে হল... যার গলায় রাধামাধবের সুর... সে ভিখারি হয় কি করে? ...
বৃষ্টির মধ্যেই বোষ্টুমি বেরিয়ে গেল আলনায় রাখা বোষ্টুমের একটা ধুতি গায়ে জড়িয়ে, যে ধুতিটা গলায় পেঁচিয়ে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দেবে ভেবেছিল। খিচুড়ির ডাল-চাল জোগাড় করতে হবে। তবে বাৎসরিক আর করবে না, যে মানুষ আছে তার আবার বাৎসরিক কি? মানুষের দুটো দেহ, সুক্ষ্ম আর স্থূল। সুক্ষ্মদেহে সে চিরন্তন। জন্মাষ্টমী যার হয় তার কি বাৎসরিক হয়? তবে?