স্টেশানের বাঁধানো বেঞ্চে বসে, বৃদ্ধা। হাতে জপের থলি। গায়ে নামাবলী। কপালে চন্দনের তিলক। তাকিয়ে আছে উল্টোদিকের প্লাটফর্মে। দুটো বাচ্চা, যে বাচ্চারা স্টেশানেই জন্মায়, বড় হয়, তেমন দুটো বাচ্চা, প্লাস্টিকের উপর একজন বসে, আরেকজন হুড়হুড় করে টানছে তাকে, তাদের হাসিতে চারদিক ঝমঝমিয়ে উঠছে।
আমি জানি, বৃদ্ধা বৈকুন্ঠ চাইছে না, চাইছে না মুক্তি, কি ছুটি এই গরলামৃতে ভরা সংসার থেকে। কেউ চায় না। বৃদ্ধা চাইছে একজন এমন খেলার সাথী। জীবনের শুরুতে যারা আসে। মাঝে হারিয়ে যায়। তখন জীবন কঠিন, নির্মম কার্যকারণ সূত্রে বাঁধা। এক চুল এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই। তারপর একদিন ঘোর কেটে যায়। সব বাসনা আচমকা কালবৈশাখী ঝড়ের হাওয়া লেগে উড়ে যায়। ক্লান্ত অবসন্ন হৃদয় আবার খোঁজে খেলার সাথী। যার সব কিছুর মূলে থাকবে অকারণ আনন্দ।
ট্রেনের ঘোষণা হল। তার প্লাটফর্মে না। উল্টোদিকের প্লাটফর্মে। ট্রেন এলো। আড়াল করে দাঁড়ালো বাচ্চাদুটোকে।
বৃদ্ধার চোখেমুখে কোনো পরিবর্তন নেই। কোনো অভিব্যক্তি নেই।
সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বুঝলাম। চোখ আছে, জ্যোতি নেই।
পাশে বসলাম। জিজ্ঞাসা করলেন, ট্রেন কটায়? শান্তিপুর যাব।
বললাম, দশ মিনিট আছে আরো।
উনি হাসলেন। বললেন, দেরি হয়ে গেল। ব্যাটা রেগে যাবে।
কোলের উপর রাখা ঝুলির উপর হাত রেখে বললেন, এর মধ্যে আছে, আমার গোপাল। ঘুমাচ্ছে। ওকে স্নান করাতে, খাওয়াতে হবে। বিরাটিতে আমাদের গুরুদেবের সংঘ ছিল। তুমিও সেখানে গিয়েছিলে?
উল্টোদিকের ট্রেন চলে গেছে। বাচ্চা দুটো প্লাটফর্মে নেই। কেউ তাড়িয়ে দিয়েছে হয় তো। আবার কোথাও কোনো পরিত্যক্ত মাঠে, বাড়িতে, ফাঁকা গলিতে খুঁজে নেবে কোনো নতুন খেলা।
ট্রেন আসছে। উনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। জপের থলির হাতে এখন লাঠি ধরা। কোলে ঝুলির মধ্যে ঘুমন্ত ভগবান। তার খেলার সাথী। আদ্যোপান্ত খেলাই তো। কখনও ভীষণ নিষ্ঠুর, কখনও কোমল। খেলার সাথী না থাকলে সবটাই বৃথা। বুঝতে দেরি হয়ে যায়, এই আর কি!