Skip to main content

ভিক্ষায় বেরোতে আলিস্যি লাগে এখন। বৃষ্টি পড়লে তো আরো। বিছানায় শুয়ে শুয়েই চালডালের হিসাব হল। আরো দুদিন চলে যাবে। দেওয়ালের কোণে একটা মাকড়সা। ঝড়জলে ঘরে এসে ঢুকেছে। ঘরে যা আরশোলা ওর সারাজীবন চলে যাবে। পশুপাখি-কীটপতঙ্গ ভিক্ষা করে না। খাবার খোঁজে। কাড়াকাড়ি করে। সে ভিক্ষা করে। রত্না বোষ্টুমি। লোকে বলে। সে নিজেকে বলে - "অখাদ্য!" যত বয়েস বাড়ছে তত মাথার মধ্যে প্যাঁচ বাড়ছে। সংসারটা জিলিপির মত লাগে। প্যাঁচ আছে মিষ্টত্ব নাই। ঠাকুরকে তাই সবাই মিষ্টি ভোগ দেয়। ঠাকুর সব বানিয়েছে জগতে, কিন্তু মানুষের মনে মাধুর্য দেয় নাই। তাই মানুষ নকুলদানা, সন্দেশ, মিষ্টিফল ঠাকুরকে দেয়। কে কবে করোলা চিরে ঠাকুরের পাতে দিয়েছে! কেন দেবে না?

    রত্নার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। রত্না গায়ের কাপড়টা জড়িয়ে নামল বিছানা থেকে। দরজার কাছে বালতিতে রাখা জল। মুখেচোখে ছেটালো, কুলকুচি করল। কুলকুচির জলটা অল্প লাল। বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে উঠান দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। ষাটের গোড়ায় এসে গেছে। তবু সারারাত মুখে খয়ের আর সুপুরি না রাখলে ঘুম হয় না। লাল কষে বালিশ ভেজে। বোষ্টম কত বকত। শুনতে চাইত না রত্না। এমনকি বোষ্টমের রেলে কাটা পড়া শরীরটা দেখতে দেখতেও মনে হচ্ছিল যেন কেউ খয়ের মাখিয়ে সবুজ ঘাসে শুইয়ে রেখেছে বোষ্টমকে। 

    রত্নার মাড়িতে ক্যান্সার। অনেকটা ছড়িয়ে গেছে। রত্না এখন কৃষ্ণের না, যমের। যম বাড়ির দাওয়ায় চাটাই পেতে ঘুমায়। অবিকল তার বাবার মত দেখতে। কানের উপর কালো চুল, লুঙ্গিটাও বাবার মত পেটের নীচ অবধি নামানো, যেন এই খুলে পড়ে যাবে। মা বলত আরে উঁচো করে বাঁধো! বাবা হাসত। হাতপাখার ডান্টি দিয়ে পিঠ চুলকাতে চুলকাতে বলত, খুলেছে আজ অবধি? মায়ের মুখে কপট রাগ ফুটে উঠত! রত্নার ছেলেমেয়ে নেই। ছিল, জন্মেই মরেছে। ওই যমই নিয়ে গেছে। তখন যমের মুখের দিকে তাকানো হয়নি। এমনকি বোষ্টমকে যখন নিতে এসেছে তখনও দেখেনি ভালো করে। তখন শোক ছিল। এখন ভালো করে দেখে। রোজ দেখে। বাবার মত ডান হাতটা মাথার নীচে রেখে শোয়। বাবার মত মুখের থেকে লাল গড়ায়। রত্না তার বিয়ের শাড়িটা রেখে আসে যমের পাশে। লালা মুছবে বলে। 

    রত্না উঠে এসে বসল বিছানায়। আজ শরীরটা ভীষণ দুর্বল। মাথাটা টলছে। গা গুলাচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব জ্বর। সব ওষুধ ফেলে দিয়েছে রত্না। ধুর, ভাতই গিলতে পারে না, ওষুধ গিলে কি হবে?

    যম ঘরে ঢুকল। বাবার মত পাশে বসল। বলল, খুব কষ্ট হচ্ছে? যম তার বাবার মত স-এর দোষে কথা বলে.. কস্ট হচ্ছে…??

    রত্না মাথাটা এলিয়ে দিল। যম ধরল না। মাথাটা খাটের উপর এলিয়ে পড়ল। পুরো মাথাটা জুড়ে ক্যান্সার। যম মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাবার মত যমের বাঁ হাতের তর্জনীর মাথায় কড়া। একতারার তার টেনে টেনে। যম তুমিও কি বাউল?

    জানলার বাইরে তাকিয়ে রত্না। বোষ্টম মিঞা মল্লার শিখিয়েছিল। বোষ্টমের ওসব গানে খুব ঝোঁকও ছিল। সে চাইত লোকে শুনুক। কিন্তু ভিখারির গলায় ওসব খোলে নাকি? রত্নার তেমন কোনোদিন ভালোও লাগত না ওসব গান। কিন্তু এই সুরটা মনে ধরত। আজ আবার অনেকদিন পর গাইতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু গলায় সুর নেই, গলায় এখন নরম মাটি, অল্প চাপ দিলেই রক্ত বেরোয়। রত্নার পুরো শরীরটা নরম হয়ে যাচ্ছে। বাইরে কাঁঠাল গাছটা কি আনন্দে স্নান করছে। তাকে বাইরে ডাকছে। রত্না যমের দিকে তাকালো। যম বাবার মত বড় চোখ করে বলল, না। যমেরও বাবার মত চোখের কোণ লাল। 

    রত্না চোখ বন্ধ করল। কিন্তু ঘুম আসবে কি করে? খিদে পাচ্ছে যে। কালকের ভাত আছে অল্প। রত্না মাথাটা তুলতে গিয়েও পারল না। সারা শরীর জড়িয়ে আসছে। তবু কোনোরকমে যমের হাতটা ধরে রান্নাঘরে এলো। রান্নাঘর বলতে বারান্দার একটা কোণ। ভাতের বাটিটার ঢাকা সরিয়ে দেখল পিঁপড়ে হয়ে গেছে। লাল পিঁপড়ে। রত্না বাটিটা নিয়ে এগোতে যাবে, চোখে পড়ল একটা উচ্ছে। অল্প হলুদ হয়ে গেছে। রত্না উচ্ছে আর ভাতের বাটি নিয়ে খাটে বসল। ভাতের বাটিটা খাটে রেখে, উচ্ছেটা দু-টুকরো করল। এক টুকরো ভাতের উপর ফেলে আরেক টুকরো নিয়ে সিংহাসনের দিকে এগোলো। যেন শ্বাস ফুরিয়ে আসছে এত কষ্ট হচ্ছে বুকে। তবু উবু হয়ে বসে একটা পেতলের থালায় উচ্ছের টুকরো রাখল। ঠোঁটের কোণে অল্প হাসির রেখা দেখা গেল। রত্না হাঁটুর উপর ভর করে উঠল, খাটে এসে বসল। খিদে পাচ্ছে খুব। 

    রত্নার শুকনো খটখটে জিভের উপর দিয়ে লাল পিঁপড়ে হেঁটে যাচ্ছে। লালা বেরোয় না দিনের বেলায়। খয়ের না দিলে লালা বেরোয় না। খয়ের আনতে হবে। উঠে গিয়ে খয়েরের একটা টুকরো নিল। গুঁড়ো করার ক্ষমতা নেই। বড় এক টুকরো খয়ের ভাতের সঙ্গে মেখে মুখে পুরে দিল। উচ্ছের বিচি আর খয়ের দেওয়া ভাত গিলতে গিয়েই হল বিপত্তি। সবটা গলায় গেল আটকে। মুখটা পুরো গ্রীষ্মের পাতকোতলার মত শুকনো। জল... জল.. চাই জল। রত্না জলের জন্য চারদিকে তাকালো। খাবার জল ভরা হয়নি কাল। আশেপাশে যম নেই কোথাও। জল বলতে পুকুর। এখন টাইমের জল আসে না। পাইপ ফাটা। পুকুর অবধি যাবে কি করে? কিন্তু যেতে তো হবেই….

    শ্বাস আটকে আসছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। বুকের ভিতর যেন জলের খলখল শব্দ শুনতে পাচ্ছে রত্না। একটা বড় নদী পেরিয়ে যাচ্ছে যম, ডিঙি বেয়ে। বৃষ্টির জলে চারদিক ঝাপসা। যম বাবার মতই বাঁহাতি। জলের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে রত্না। ডুবে যেতে যেতে দেখল ঠাকুর উচ্ছেটা চিবিয়ে খাচ্ছে। উচ্ছের বিচি ভেঙে বেরোচ্ছে খয়ের গোলা টাটকা লাল লালা। মুখটা তিতের দাপটে কুঁচকে। রত্নার হাসি পাচ্ছে। গলার মধ্যে সব দলা পাকানো। হাসল না তাই।