[বরাবরই আমার অভ্যাস অল্প মন খারাপ হলে ছাদে বসে মেরি বিস্কুট খাওয়া। আর বেশি মন খারাপ হলে ক্রিম কেকার। কিন্তু কোনো কারণে যদি মন খারাপের সাথে রাগও হয়, তবে ছাদের কার্ণিশে একটা পা ভিতরে আর আরেকটা পা বাইরে ঝুলিয়ে কদমা খাই।
আজ কদমাই খাচ্ছিলাম ছাদে বসে, দুপুরবেলা। মন খারাপের কারণ ফেসবুক দেখতে পাচ্ছি না, আর রাগের কারণ জিও স্পিড স্লো। তা দুটো কদমা খেয়েছি কি খাইনি, আজ সিলেবাসের বাইরে একটা বীরখণ্ডিও নিয়ে গিয়েছিলাম, সেটাতে প্রথম কামড়টা বসাতেই ছোটোবেলার একটা ঘটনা স্পষ্ট মাথায় এলো। যেন এই সদ্য সদ্য ঘটেছে। ধাঁ করে ছাদে বসেই লিখে ফেললুম।
কিন্তু যাদের বয়েসের জন্য বুদ্ধিগুলো কুকুরের ল্যাজের মত হয়ে গেছে তাদের জন্য এ লেখা নয়, বরং যাদের মধ্যে এখনও কেঁচোর মত সরল সোজা বুদ্ধি আছে, এ লেখা তাদেরই জন্য। আর হ্যাঁ, Suman চট করে একটা ছবি এঁকে দিয়েছে আমার বর্ণনাটা শুনে।]
তখন চেন্নাই থেকে হাওড়া রাজধানী চলত। এটা বলছি যখন আমি অনেক ছোটো, এই ১৯৬০ কি ৬১ হবে। ভেলোর হাসপাতালে যেতাম প্রত্যেক বছর। ইডা স্কাডার মানে ভেলোর হাসপাতালের যিনি প্রতিষ্ঠাত্রী তিনি তখনও বেঁচে। বিধানচন্দ্র রায় আর নীলরতন সরকারও মাসে দু'দিন করে বসতেন ভেলোরে তখন। ইডা স্কাডারের খুব বন্ধু ছিলেন দু'জন। তো যে জার্নিটার কথা বলব বলে লিখতে বসা, সেটা বলি।
হাওড়া থেকে চেন্নাই রাজধানী এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা ছিল দুপুর দুটোয়, ছাড়ল রাত আটটা। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ছিল। তুমুল কালবৈশাখী হল সেদিন। আমরা তখন পায়রাডাঙা থাকতাম। লোকাল ট্রেন বন্ধ। কি করে শিয়ালদহ যাব ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু ভেলোর যেতে তো হবেই, নীলরতনবাবু ওখানেই তখন। মাসখানেক আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া। যা হোক, বাবা ইডা স্কাডারকে ফোন করলেন। উনি বললেন, 'না, কিছুতেই ডেট পিছনো যাবে না।' অগত্যা আমরা ঝড় মাথায় করেই বেরোলাম।
একটা ট্যাক্সি নিয়ে প্রথমে এলাম কৃষ্ণনগর। তারপর গঙ্গা পেরিয়ে আবার ট্যাক্সি নিয়ে হাওড়া। ট্রেন যে দেরি করে ছাড়বে রেডিওতে আগেই জানতে পেরেছিলাম আমরা। ট্রেন ছাড়ল। তখন স্টীম ইঞ্জিন। যদিও আমরা এসি-তে ছিলাম, তবু বাইরেটা কালো ধোঁয়া হয়ে গেল দেখতে পেলাম। হঠাৎ দেখি স্টেশান ব্যান্ডেল। আরে এ কি! আমরা কি ভুল ট্রেনে উঠলাম? এ তো দিল্লী যাওয়ার রাস্তা! বাবা তক্ষুণি টিটির কাছে দৌড়ালেন। জানা গেল, চেন্নাই-কলকাতার লাইন ঝড়ে কিছুটা উড়ে গেছে, তাই উত্তরপ্রদেশ হয়ে ট্রেনটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তখনকার দিনে মোবাইল ছিল না। কিন্তু এদিকে যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল হয়ে যাওয়ার জোগাড়! খুব মুষড়ে পড়লেন বাবা। 'তবু যাওয়া যাক', এই বলে উপরের বাঙ্কে চড়ে শুয়ে পড়লেন, বললেন, "লক্ষ্ণৌ এলে ডেকে দিস।"
একজন ভদ্রলোক আমার উল্টোদিকের সিটে বসে। আমাদের সব কথা শুনছিলেন, কিন্তু কোনো মন্তব্য করছিলেন না। এবার বাবা শুয়ে পড়লেন দেখে আমার সিটে এসে বসে বললেন, "তোমার কি হয়েছে খোকা?"
অজানা ব্যক্তিকে রোগের কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। চুপ করে রইলাম। উনি কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, "আমায় বলতে পারো, কোনো অসুবিধা হবে না।"
ট্রেন চলছে। উপরে বাবা নাক ডাকছেন, মনটা হঠাৎ কেমন বিশ্বাসী হয়ে গেল ভদ্রলোকের উপর। বললাম, "আমার একটা অদ্ভুতরকম ব্যামো। যদি না হাসেন তো বলি।" উনি বললেন, "না না বলো, আমি হাসব না।" বললাম, "আমি হাওয়া দেখতে পাই... রঙ শুনতে পাই... গরম-ঠাণ্ডা হাতে করে নিয়ে খেলতে পারি। আপনি ভাববেন, আমি বোধহয় নেশাভাঙ করি, আদতেও তা না, মাইরি বলছি, মা শীতলার দিব্যি, এমন কিছু নয়। এই যেমন ধরুন আপনার মাথায় যে ডাই করা রঙ সেটা রঙটা এক্ষুণি বলল আমায়। তাছাড়া দেখুন এই যে হাওয়াটা আমার পাশে বসে ও বলছে আপনার গত শীতে ফুসফুসে ইনফেকশান হয়েছিল মারাত্মক। আরো যেমন ধরুন..."
ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, "থাক থাক। আমি বুঝেচি। তা ডাক্তার কি বলছেন?"
"ডাক্তার বলছেন অপারেশান করতে হবে। আমার নার্ভগুলো ভুল অঙ্গের সাথে সেট করা হয়ে আছে। ওগুলোকে জোড়া লাগাতে হবে ঠিক করে তবে হবে।"
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "ও..." তারপর চিন্তিত হয়ে গেলেন। মাথা নীচু করে কি একটা ভাবতে ভাবতে বললেন, "একটা উপকার করবে আমার?"
এরকমভাবে কথা বড়োরাই বড়োদের বলেন, কেউ আমায় বলছে শুনে খুব মজা হল, বেশ গুরুত্বপূর্ণ লাগতে লাগল নিজেকে। বললুম, "হ্যাঁ, বলুন না।"
তিনি 'দাঁড়াও' বলে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর স্যুটকেস খুলে একটা ছবি এনে আমার সামনে ধরলেন। বললেন, "খুব মন দিয়ে ছবিটা দেখো। এটা একজন খুব খারাপ লোকের ছবি। এ আমাদের দেশের ক্ষতি করতে চাইছে, বিদেশিদের সাহায্যে। কি ক্ষতি তুমি বুঝবে না। শুধু বলো লোকটা সম্বন্ধে কিছু বলতে পারো কিনা। আমি সিবিআইতে কাজ করি", বলে ওনার কার্ড দেখালেন।
আমার তো উৎকণ্ঠায় গলার কাছে বুজে আসল কি একটা। মন দিয়ে ছবি দেখব কি, বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর মত আওয়াজ হচ্ছে। তবু মনটা ধীরে ধীরে শান্ত করে ছবিটা দেখতে লাগলাম। বললাম, "লোকটার গায়ের রঙ বলছে ও বিহারের রোদ গায়ে পেয়েছে। উত্তরপ্রদেশের জলে স্নান করেছে।"
ভদ্রলোক বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "একদম ঠিক!" খুব উত্তেজিত লাগল ওনাকে। তারপর বললেন, "এখন কোথায় বলতে পারো?"
বললাম, "হয়তো পারি, কিন্তু তার জন্যে খোলা হাওয়া লাগবে।"
আমরা দু'জনে ট্রেনের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। উনি আমায় পিছন থেকে জাপটে ধরলেন, আমি ছবিটা হাওয়ায় মেলে হাওয়ার কথা শুনতে চেষ্টা করলাম। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে... 'হুহু' করে ঝোড়ো বাতাস বইছে... ট্রেনটা 'হুশহুশ' করে ছুটে চলেছে... উফ্ কি থ্রিলিং যে লাগছিল! হঠাৎ শুনলাম হাওয়া বলছে, রায়পুর... রায়পুর...
ভদ্রলোক ছোটাছুটি শুরু করে দিলেন। ট্রেন রায়পুরের দিকে ঘোরাতে হবে। দেহেরি-অন-সোন এ ট্রেন দাঁড় করানো হল। ট্রেনের ড্রাইভার, গার্ড, আরো কত অফিসার মিলে সেকি তর্কাতর্কি রে বাব্বা! এ বলে হবে... ও বলে হবে না...
অবশেষে ঠিক হল, আমরা রায়পুর হয়েই যাব। ও, ইতিমধ্যে সেই ভদ্রলোক ভেলোরে তার করে দিয়ে সব জানিয়ে দিয়ে আমাদের অ্যপয়েন্টমেন্ট পরের দিকে ফিক্সড্ করার অনুরোধ জানালেন।
পরের দিন রায়পুরে থিকথিক করছে পুলিশ। বাবা ঘুম ভেঙে উপর থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, "হ্যাঁ রে লক্ষ্ণৌ এলো?"
আমি বললাম, "না রায়পুর।" বাবা তড়াক করে লাফ দিয়ে নামলেন নীচে। এদিকে ঠিক সেই সময় একজন এসে হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বললেন, "এই যে ভেলোরের টেলিগ্রাম।"
যা হোক আমরা অবশেষে চারদিন পর কন্যাকুমারী ঘুরে ভেলোর পৌঁছালাম। অপারেশান খুব ভালো হল। সেই সিবিআই -এর ভদ্রলোকও এসেছিলেন। উনি ডাক্তারকে বলেছিলেন যে অপারেশানটা না করলে উনি আমায় সিবিআই -তে নিয়ে নেবেন। তা ডাক্তার বললেন, "সেটা ঠিক হবে না। ব্রেনে শর্ট-সার্কিট বেশিদিন থাকা ভাল না, অস্বাস্থ্যকর।'
এসব কথা সবাইকে বলা যায় না বলে অ্যাদ্দিন বলিনি, আজ বলেই ফেললাম। তবে যেটা ভিতরের খবর সেটা হল ভারত সরকার তারপর থেকে নাকি এরকম হাওয়া দেখতে পাওয়া, রঙ শুনতে পাওয়া লোকের খোঁজ করে। এটা লিগ্যালও করে দেওয়া হয়েছে। তাই আপনাদের মধ্যে যদি কেউ সেরকম থাকেন, তবে সত্ত্বর যোগাযোগ করবেন। প্রতিমাসের তৃতীয় রবিবার রাত দুটোর পর সিবিআই -এর ওয়েবসাইটে একটা লিঙ্ক দেয় ওরা, অনলাইন টেস্টের জন্য। পাশ করলেই চাকরি বাঁধা। আজ উঠি তবে, টাটা...