গঙ্গার ধারটা বিকালে প্রচুর লোকজন হয় এখন। বিশুপাগলার রাগ হয়। অকারণেই রাগ হয়। এত লোক কেন? আগে তো হত না। সে সবাইকে মুখ খারাপ করে। যেদিন প্রচণ্ড রাগ হয়, সেদিন থুতুও ছিটিয়ে দেয় লোকেদের গায়ে। আর দেবে নাই বা কেন? এই গঙ্গার ধারটা তো জঙ্গলই ছিল। বিশু পাগলা আগে শ্মাশানে থাকত। তা বছর তিরিশ আগের কথা। তারপর এই জলা জঙ্গলটায়। সে আর কালু, হরেন, ডাবলু। এরা সব ওর নেড়ি কুকুরের দল। তারা কোথায় এখন? কেউ নেই। বিশু পাগলা ওদের মনে করে একটা করে বিস্কুট কিনে আনে প্রতি বছরের পয়লা বৈশাখে। গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়। তবে গত দুবছর আর দেওয়া হয়নি। কাত্তিকদা বিশুকে খুব স্নেহ করত। তার একটা চায়ের দোকান ছিল, ওই গঙ্গার পূবদিকে কয়েক পা এগোলেই, মিত্তির মাষ্টারের বাড়ির লাগোয়া। তা সেও মোলো আর বিশুর বরাদ্দ বিস্কুটেরও দিন ফুরাল। তার ছেলেগুলো বড্ড হারামি, বিশু বলে। তার কুকুরগুলোর জন্যে এখনো মনটা কেমন করে। বিশেষ করে যখন রেলের কারখানার সিটিটা পড়ে ভোঁ....করে, ডাবলুটা কি তারস্বরে চেঁচাত ওর সাথে। বিশুর এখনো মনে পড়ে।
ডাবলুটা অনেকদিন বেঁচেছিল, না বিশুদা?
হুম।
কি দরকার ছিল এই গঙ্গার শোভা বাড়াবার প্রকল্পের? আরে বড়লোক, ভদ্দরলোকদের তো যাবার অনেক জায়গা আছে। কিন্তু বিশু পাগলার? সে কোথায় যাবে? তার তো টাকা পয়সাও নেই যে দার্জিলিং বা পুরী ঘুরে আসে।
বিশু মাঝে মাঝেই শ্মশানে যায়। মানে যেতেই হয়। না হলে পরার জামা কাপড় পাবে কোত্থেকে? কেউ কেউ কাঁদে, কেউ কেউ কীর্ত্তন করে, কতলোক গল্প করে। কতলোক আবার মাল খেয়ে বেলেল্লাপনা করে। বিশুর মাথায় ঢোকে না। আর কেউ মরলে এত কাঁদারই বা কি আছে তাও তো বোঝে না বিশু। সে ভাবে ভালোই হল তো শালা। কি খাবে, কি পরবে, কোথায় হাগবে, কোথায় মুতবে এসব ভাব্বার ঝক্কি থেকে বেঁচে গেল তো যে মরল। সে অনেকবার চুল্লীর কাছে দাঁড়িয়ে দেখেছে, কেউই তো ভিতর থেকে "আমায় বার করো, আমি পুড়িয়ে দিল গো" বলে চীৎকার করে না! খুশী খুশীই তো পুড়ে যায়। সে দেখেছে ছাই হয়ে ওই পাইপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আকাশে মিশে যায়। কোথায় যায়? আর জেনেই বা কি হবে? যায় তো যায়, আপদ যায়। সে আবার জামা কাপড় খুঁজতে শুরু করে। অনেকে কটা টাকাও দেয়।
টাকা অবশ্য জমায় না বিশু। বাবা বারণ করত। তার মনে আছে। তার বাবা তাকে খুব আদর করত। আর সব্বাই কেমন ছ্যাড়াবাড়া করত সে কাছে গেলেই। মাকে যদিও তার মনে নেই। মা নাকি আগেই মরে গেল। তারপর তাদের বাড়িটা বিক্রি করে সবাই যে কোথায় গেল? বিশু অনেকবার স্টেশানে গিয়ে বসে থেকেছে, সেই আগেকার কথা। যে রাতে সবাই চলে গেল। সবাই মানে তার দুই দাদা আর বৌদিরা। সে রোজ ভাবত আজ বোধহয় ওরা আসবে। আসল না। আর কোনোদিনই এলো না। তাদের বাড়িটা ভেঙে কি বড় উঁচু একটা ফ্ল্যাট হল। সে অনেকবার ঢুকবার চেষ্টা করেছিল, ওর বাবার টর্চটা শুধু আনবে বলে। ওটা ওর দাদারা ওকে দিয়ে গিয়েছিল। তা দিল না।
বিশুকে অনেকবার এই পার্ক থেকে বার করা হয়েছে। মেরে তাড়ানো হয়েছে। তবু এমন ঠ্যাঁটা নাকি সে, যাকে কিনা বলে সেয়ানা পাগল।
বিশু যখন রাতে গঙ্গার ধারে শুত, তখন বহুত লোক আসত মেয়েদের নিয়ে রাত্তির বেলায়। কি যে সব করত!
একদিন রাতে এল পুরুত ঠাকুর। তাদের পাড়ার কালী মন্দিরের। আরে ওর মেয়ের বয়সী মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে। বিশু একটা চ্যালাকাঠ জোগাড় করে এমন মার মেরেছিল। হলে হবে কি। পরের দিন গুচ্ছের চ্যাংড়া ছেলে কোত্থেকে এসে তার উপর চড়াও হল। কি মার মারল। চোখে ভাল দেখতে পেত না কদিন। ওই কুকুরগুলোর জন্যেই আরো বেশি কিছু করতে পারেনি এই রক্ষে।
তবে ওই মেয়েটার শরীর যেদিন দেখল, পুরো ল্যাঙটা, নদীর পাড়ে পড়ে। সে মন্দিরে গিয়েছিল। জোর করে ঢুকে, দিয়েছিল আচ্ছা করে গালি মাকে আর ওই পুরুতকে। পুলিশকেও বলতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কাছে আসতেই কেন যেন সে তার দাদাদের কথা বলতে শুরু করল, "জানো আমায় নিল না। তোমরা বলতে পারবে ওরা কোথায় গেল? খুঁজে দেবে? আমার বাবার টর্চটা কোথায় বলতে পারবে? "
ওরা তাড়িয়ে দিল।
বিশু পাগলা যেদিন মরল সেদিন ওর বোঁচকার মধ্যে থেকে বেরোলো একটা সোনার আংটি। মন্দিরের সেই মেয়েটার হাতে ছিল। সবাই ভুলে গিয়েছিল। পুরোনো যারা তারাও। মন্দিরের সেই পুরোহিত ভোলেনি। তার বয়েস এখন আশির দোরগোড়ায়। সে বিশুর মরার খবর পেয়ে দেখতে এসেছিল। খুব কেঁদেছিল। তার পারলৌকিক সব কাজের খরচ দিয়েছিল।
আর বহু বছর পর সে আবার মন্দিরে ঢুকেছিল, মাকে প্রণাম করতে। নতুন পুরোহিত জিজ্ঞাসা করল, অ্যাদ্দিন পর দাদা!
সে বলল, প্রায়শ্চিত্ত করছিলাম। আজ শেষ হল, তাই। এই আংটিটা নাও তো ভায়া, মায়ের হাতে পরিয়ে দাও।
নতুন পুরোহিতের চোখ ছানাবড়া, সে বেশ কিছুক্ষণ আংটিটা দেখে বলতে গেল, দাদা এতো বহু পুরোনো কাজ, খাঁটি সোনা!
ততক্ষণে তিনি মন্দিরের বাইরে চলে গেছেন।
(ছবি: সুমন)