Skip to main content

শীতের সকালে রোদের আমেজ মেখে রসিক মিঞা বসে। আজকাল বিক্রি-বাট্টা কম। জোয়ান বয়সের মত অত পারে না এখন। তাছাড়া এ ধানতলায় এখন দোকানেরও অভাব নেই। বদর ১৯০ টাকা কেজি চিকেন দিলে, জগন্নাথ হয় তো দেখো দিচ্ছে ১৭০ টাকায়।

রসিক আজ দিচ্ছে ১৭৫ টাকায়। রবিবার। মোটামুটি ভালোই বিক্রি হয়েছে। উঠে গেলেই হয়। একটা বাঁশের মাচা মতন, সেখানেই আজীবন বসে মুরগী বেচে গেল রসিক। আরো কদ্দিন কে জানে! চিন্তা মা মরা মেয়েটার জন্য। নিকা করিয়ে দিয়েই যে শান্তিতে মরব, সে উপায়ও তো নাই। মেয়েটার মাথাটাই তো খারাপ। এমনিতে দেখতে শুনতে ভালো। চেহারাও ভালো ছিল। এখন কেমন শুকিয়ে গেছে। বয়েসও তো হল প্রায় তিরিশের কাছাকাছি মেয়েটার।

চম্পা উবু হয়ে বসে রোদ মাখছে আব্বার দোকানের সামনেই বসে রাস্তার ধারে। চম্পা হাসছে। একটা নিমের কাঠি নিয়ে দাঁতে চিবাচ্ছে। আব্বার মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর খুশীর হাসি হাসছে। এ হাসির কি মানে রসিক জানে না। সেও হাসছে। তার ফোকলা দাঁত, রোদ চকচকে দাড়ি, কুঁচকে যাওয়া চোখ, তাকেও দেখাচ্ছে বেশ।

রসিক উঠল। দোকানপাট গুছিয়ে, মেয়েটাকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে, প্যাডেলে চাপ দিল। কোমরটা টাটিয়ে উঠল। বয়েস হচ্ছে শরীর জানান দিচ্ছে। আগে একটা কিছু হলে ছেড়ে যেত, এখন আর কোনো রোগই ছেড়ে যায় না।

চেনা রাস্তা গড়িয়ে গড়িয়ে রসিক বাড়ির সামনে চলে এসেছে। এদিকটা বেশ ঢালু রাস্তা। সাইকেল নামছে হুড়হুড়িয়ে। চম্পা তার কোমরটা জড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে। রসিক বাড়ির দরজার সামনে এসে সাইকেল থামালো। চম্পা সাইকেল থেকে নেমেই বাবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে চাবিটা নিয়ে দরজার তালাটা খুলে বলল, এসো।

রসিক ঘরে ঢুকে কুয়োতলায় গেল। হাত মুখ ধুয়ে বসল। চম্পা গান গাইছে। হিন্দি গান কিছু। রসিক ভাত বাড়ল। দুজনের মত ভাত। নিজে খেল। মেয়েকে খাওয়ালো। মেয়ে দৌড়ায়। রসিক দৌড়াতে পারে না। কাকুতিমিনতি করে, খেয়ে যা মা... খেয়ে যা।

অনেক রাত। চম্পা ঘুমিয়ে মেঝেতে। খাটে শোয় না। পড়ে গিয়ে মাথা ফাটায় বারবার। রসিকও মেঝেতে শোয়।

হঠাৎ চম্পা ঘুম থেকে উঠল। বলল, আব্বা আজ আমার নিকা না? তুমি ওঠো

রসিক আচমকা ঘুম থেকে উঠে কি বলবে বুঝতে পারল না প্রথমে। একবার আসতে আসতে বলল, না মা, আজ নয়।

চম্পা ততক্ষণে উঠে ঘরে আলো জ্বেলে সাজতে বসে গেছে। রসিক ঘড়ি দেখল, রাত আড়াইটে। রসিকের কান্না পেল। কিন্তু ওঠার শক্তি শরীরে জোগাড় করে উঠতে পারল না। মনটা বড় অবাধ্য পাথরের মত বসে।

চম্পা সাজল। বলল, চলো আব্বা বাইরে চলো।

চম্পা দরজাটা খুলে বাইরে বেরোতেই একরাশ কুয়াশা আর ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে এলো। রসিক তাও উঠল না।

চম্পা গান গাইছে। চীৎকার করছে... আব্বা... বাইরে এসো... কত মেহেমান দেখো, সবাই এসে গেছে…. বাইরে এসে দেখো…. এসো এসো….

রসিক উঠল। গায়ের চাদরটা জড়িয়ে বাইরে এলো। সাইকেলটা ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে শোয়ানো। সাইকেলটা বলল, যাও না, মেয়েটার সুখে সুখী হও। ভাবো না স্বপ্ন দেখছ... যাও.. যাও... ও যখন আমার উপরে চড়ে, আমি ওর স্বপ্নের ভার টের পাই... তোমার বুকে দুঃস্বপ্নের কলকল শব্দও শুনি। যাও, এখন কটা মুহূর্ত ওর সঙ্গে থাকো।

রসিক মেয়েটার কাছে এলো। সে কুয়োতলায় বসে। অল্প তারার আলো এসে পড়েছে তার মুখে। কি উজ্জ্বল। কি ভয়ংকর। কি ব্যথার আনন্দ। রসিক তার মাথায় হাত রেখে বলল, জামাই কই রে মা?

মেয়েটা তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এই দেখো, তুমি চশমা পরোনি কেন... ওই তো আমায় বিয়ে করতে এসেছে….

রসিক বলল, কে রে?

মেয়েটা অধৈর্য হয়ে বলল, উফ তুমি না আব্বা…. আরে আমাদের বসার ঘরে বসে আছে তো…..

চম্পা ছুটল ঘরের দিকে। রসিক ধীরে ধীরে গেল তার পিছনে। ঘরে গিয়ে দেখল, চম্পা তার আর সাবিনার বিয়ের ছবিটা আঁকড়ে বসে টুলে। রসিক ঢুকতেই বলল, এই তোদেখো আমি আর সে... আমাদের ছবি তোলা... একে চেনো না তুমি?

রসিকের বুকের কাছটা শাবলের বাড়ির মত বাজল। দেওয়ালে ঝোলানো পাখাটা বলল, মেনে নাও না ওর কথা। তোমাদের কত দীর্ঘশ্বাস আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ির বাইরে ওই মাঠের দিকে ছেড়ে এসেছি জানো? জানো না। মেয়েটার পাশে বসো। ওর কপালে চুমু খাও। বলো আল্লাহ ওর সব আশা পূর্ণ করবেন। যাও বলো।

রসিক মেয়েটার মাথায় হাত রাখল। কপালে চুমু খেলো। বলল, আল্লাহ তোর জন্য দারুণ বর পাঠিয়েছে মা!

চম্পা আবার বাইরে বেরিয়ে গেল। কুয়োতলার পিছনে বড় মাঠ। তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার চুল এলোমেলো। সে রসিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ও আমার জন্য ট্যাক্সি নিয়ে এসেছে দেখো…. এবার আমি যাই? তুমি কেঁদো না, আমি মাঝে মাঝেই তোমায় দেখতে আসব। তোমায় আমার ফোন নাম্বার দিয়ে দেব। তুমি ফোন কোরো। ঠিকাছে?

কুয়োর বালতি বলল, যাও, যাও, ওকে জড়িয়ে আদর করো। ওর মাথাটা বুকে রাখো। তোমাদের সব দুঃখ আমি জানি। কুয়ো বলল, আমার গভীরে যত জল, তারা সব তোমাদের কথা, তোমাদের কান্না। যাও, ওর সঙ্গে কথা বলো। ওর হাতে দুটো চুমু দাও।

রসিক গেল। চম্পাকে জড়ালো। চম্পার হাতে দুটো চুমু খেল। চম্পা তার আব্বার গালে দুটো চুমু খেয়ে বলল, আসছি আব্বা

চম্পা দৌড়াচ্ছে। মাঠ পেরিয়ে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। রসিক দাঁড়িয়ে দেখছে। তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, সাইকেল, ঝুল মাখা পাখা, কুয়োর বালতি, কুয়ো। সবাই হাত নাড়ছে। দোয়া করছে। হঠাৎ একটা মুরগী ডেকে উঠল খাঁচা থেকে। সে বলল, একি করলে, তুমি আমাদের উপর নিষ্ঠুর হও, আমরা বলি না কিছু….. কিন্তু মাঠের ওদিকে যে বিরাট দীঘি... জানো না তুমি? সে যে কি গভীর জানো না তুমি? তুমি সব জানো.. নিষ্ঠুর তুমি। ভীষণ নিষ্ঠুর।

খাঁচার ভিতর থেকে তাদের মাংস বিক্রির জন্য আনা সব কটা মুরগী কেঁদে উঠল। রসিক দৌড়ালো। খালি পায়ে মাঠের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পড়ল কয়েকবার। পা কাটল। গাল ছিলে গেল। কপাল ঠুকলো। রসিক আবার দৌড়লো। ওই তো দীঘির উঁচু পাড়। ওই তো সামনেই দীঘির জল... চম্পা…. চম্পা…..

কেউ সাড়া দিল না। দীঘির জল পাড়ে এসে ধাক্কা দিচ্ছে - ছলাৎ ছলাৎ । থিতিয়ে যাচ্ছে সব। সাবিনা দাঁড়িয়ে পাশের তেঁতুলগাছটা হয়ে। তার পাতায় পাতায় শীতের বাতাসের মর্মর শব্দ। সাবিনা বলছে, ওকে আমার কাছে আসতে দাও, আসুক, আসুক। দীঘি বলল, ফিরে যাও রসিক। ও ফিরবে না।