Skip to main content

কেবিনে ঢুকতেই চাঁপা বলল, মাসীমা আজ বমি করেছেন।

বিশাখা সোফায় বসতে বসতে এসিটা দু দাগ কমিয়ে দিয়ে বলল, কিছু উল্টোপাল্টা খেয়েছে আজ?

মোচা… ছোলা দিয়ে…. আমায় ক’দিন জোর করছিলেন…. আমার কেমন মায়া লাগল…. আমি…

চাঁপার চোখে জল চলে এলো। বিশাখার রাগ হয় না আর। ক্লান্ত লাগে। চাঁপাকে বলল, বোস… আয়।

চাঁপা পাশে বসে মোবাইল অন্‌ করে বলল, দেখো দিদিভাই… কি আনন্দ করে মাসীমা খাচ্ছেন!

চাঁপা রেকর্ড করেছে। তার মা, অমন দুঁদে হেডদিদিমণি মা, যিনি কিনা আজীবন ছোঁয়াছুঁয়ি জাতপাত মেনে এসেছেন সে চাঁপার হাতে রান্না খাচ্ছে? সত্যিই কি ভালোবেসে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে মা।

বিশাখা চাঁপার দিকে তাকালো। সে উৎফুল্ল মুখে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে। বিশাখা বলল, আমার মোবাইলে সেন্ড করে দে… দাঁড়া আমি হটস্পট অন করি… তুই মোবাইলটা আমায় দে…..

=====

বিশাখার বয়েস চল্লিশের কোটা পেরিয়েছে সদ্য। বিয়ে করেনি। আইটিতে কাজ করে। একা একটা ফ্ল্যাটে থাকে। মা থাকত বেলঘরিয়া। একাই। চব্বিশ ঘন্টা দেখাশোনার লোক থাকত যদিও। চার মাস আগে লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে।

আজ ঘুমাচ্ছে সারাদিন। ঘোর লেগে আছে যেন। আর সময় নেই বেশি। বিশাখা বুঝতে পারছে। রোজ অফিস থেকে আসার সময় ফুল কিনে আনে। মা ফুল ভালোবাসে কিনা জানেনি কোনোদিন। নিজের জন্য আনে। টেবিলে রাখা ফুলদানিতে সাজায়। নিজের ভালো লাগে। এত কাছে মৃত্যুকে বড় অসহ্য লাগে। মৃত্যু সব সময়েই যেন ইন্ট্রুডার।

মা কোনোদিন ফুলের দিকে তাকিয়েছে? মনে হয় না। বিশাখা কেবিনে এসেই আগে বেডশিটের দিকে তাকায়। তারপর মায়ের ড্রেসের দিকে। কোথায় ভিজে আছে কিনা, কোথাও ব্লাড আছে কিনা।

======

মা আর কথা বলেনি। বিশাখা সোফায় বসে বসে বই পড়েছে। মোবাইলে সিনেমা দেখেছে। টেক্সট করেছে। ইনস্টাগ্রামে ছবি দিয়েছে। মা পাশে। এই বোধটাকে বুকের মধ্যে বারবার জন্ম দিয়েছে। নাড়াচাড়া করেছে। বারবার মাথায় ঘুরে ফিরে এসেছে মায়ের বেডে বসে খাওয়ার দৃশ্যটা। মানুষ এমন হয়ে যায়? নিজের ব্যক্তিত্বের কিছুমাত্র রেশ থাকে না?

=====

ফাঁকা কেবিনটায় বসে। তখন মায়ের জ্ঞান ছিল। চাঁপা মাকে টয়েলেটে নিয়ে গেছে। মা বসতে চাইছে না কমোডে, চাঁপা বোঝাচ্ছে। বিশাখা মায়ের বেডে শুলো। আজ বাড়ি থেকে সোজা এসেছে। শাড়ি পরেছে। মায়েরই শাড়ী। পা'টা টানটান করে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে বিশাখা। মৃত্যুর আগে কিভাবে মানুষ? বিশাখার জীবনে তেমন কেউ নেই। চল্লিশের পর যে বন্ধুরা টিকে যায়, তারা মোটামুটি টিকেই যায়, কোথাও পড়েছিল। যারা মতলবে এসেছিল, তারা নেই আর। মতলব ফুরিয়ে গেছে। বিশাখাও সরে এসেছে অনেকের কাছ থেকে। এই যে একা বেডে শুয়ে থাকা। সে যখন শুয়ে থাকবে? কে আসবে? কেউ এলেই কি ভালো লাগবে?

জুন মালহোত্রা, তার ইম্মিজিয়েট বস, তার এক মেয়ে লণ্ডনে পড়াশোনা করে। জুন বলে, আমি চাই একা মারা যেতে। আমি জানি আমার মেয়ে আসবে না। জুন ডিভোর্সি। এক্স হাসব্যান্ড অস্ট্রেলিয়ায়। আবার বিয়ে করেছে। উইকেণ্ডে ভিডিও কল করে। ছেলে আছে একটা। আশিষ। জুনের বাবার নাম।

সব ভীষণ প্রেডিক্টেবল হয়ে যায় একটা স্টেজের পর লাইফে। এক্সসেপ্ট ডেথ। বিশাখা শরীরটা ছেড়ে দিল। তুলোর মত। যেন সমর্পণ করছে কাউকে। কাকে? ঈশ্বর? নাকি ভবিতব্য? নাকি চিকিৎসকের হাতে? এক্সপেরিমেন্ট?

দিদি……

মা তাকিয়ে আছে। তাকে চিনতে পারছে না। বিশাখা একটু এম্ব্যারাসড। চাঁপার চোখেমুখে বিস্ময়, হাসিও। বিশাখা সোফায় বসে শাড়িটা ঠিক করতে করতে বলল, হল?

না গো…. বসেই থাকল…. তোমায় চা এনে দেব?

বিশাখার চায়ের ইচ্ছা নেই। তাও এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিটা কাটানোর জন্য বলল, বেশ, আনো। একটা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিল।

======

চাঁপা চা আনতে গেল। মা তার দিকে তাকিয়ে বসে। চিনতে পারছে না। বিশাখাও মায়ের দিকে তাকিয়ে। কি ভাবছে মা? কি ভীষণ যন্ত্রণা পাচ্ছে মানুষটা! বালিশটা মুখের উপর চেপে ধরলেই সবটা মিটে যায়। পটাশিয়াম সায়ানাইড দোকানে পাওয়া যায়? কেকের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যেত। মায়ের কেক ভীষণ প্রিয়।

"তুমি কি হাসিদির মেয়ে?"

বিশাখা হাসিমাসিকে একবার দেখেছে। হাসি মাসি নিউজার্সিতে থাকে। থাকত। মারা গেছে। গলব্লাডার ক্যান্সার। হাসিদির মেয়ের নাম অ্যানা। হাসিদির বর ছিল ইউরোপিয়ান। অ্যানার মত দেখাচ্ছে তাকে? ভীষণ ওবিজ তো অ্যানা? ছি! মা!

না, আমি তোমার মেয়ে…. বিশাখা….

"আমার মেয়ে নেই… মারা গেছে…. গঙ্গায় ডুবে…."

বিশাখা চুপ করে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে। কথাগুলো উচ্চারণ করতে জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে মায়ের। জিভে ক্যান্সার হতে পারত, তবে তো আর কথাই বলতে পারত না। নি:শব্দ কেবিনে মা মেয়ে বসে থাকত। মৃত্যুর অপেক্ষায়। কেবিনে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ। মায়ের শরীর থেকে আসছে। মৃত্যু পথযাত্রীদের শরীরে এক ধরণের গন্ধ হয়। আগেও পেয়েছে। হাস্পাতালেই। কানটা চ্যাপ্টা হয়ে মাথার সঙ্গে মিশে যায়। নাকটা বেঁকে যায়। বিশাখা গঙ্গায় ডুবে যাচ্ছে। কেউ হাত বাড়াচ্ছে একটা… কে? কে? সুকান্ত?

=======

চার বছর সম্পর্ক ছিল। এতদিন পর এসে ফিরে তাকালে শুধু শরীরের বোকামি ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। শরীর সারা জীবন বোকা বানায় মানুষকে। শেষে মৃত্যুর হাতে একা ফেলে পালিয়ে যায়। মন তো বায়বীয়। থাকলেও কি, আর না থাকলেও। বুদ্ধি চিরকাল উদভ্রান্ত।

চাঁপা চা দিয়ে মোবাইলটা নিয়ে বাইরে গেল। ছেলের সঙ্গে কথা বলবে।

"ওটা কি? কফি?"

না, চা। খাবে?

"তোমার জাত কি? যার তার হাতে আমি খাই না"।

চোখ জুড়িয়ে আসছে মায়ের। ঘুমাবে। শুতে গেলে মাথাটা বেডের লোহায় ঠুকে যাবে। মৃতপ্রায় মানুষের মাথা ঠোকা নিয়ে কেউ ভাবে না। ঠুকে যাক মাথা। বিশাখা তবু উঠল না। চায়ে চুমুক দিয়ে তাকিয়ে থাকল, অপলক। শ্বাস দ্রুত। মুখের পেশী শক্ত। কি করে মা, দেখবে। এই কেবিনে এর থেকে বেশি চেঞ্জ কি আশা করবে আর?

মাথা ঠুকল না। বালিশটার আন্দাজে মাথাটা ঠিক সরে এলো। বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

বিশাখার চোয়ালের পেশী নরম হল। চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রেখে মায়ের মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো। ঘুমন্ত মানুষকে নিজের মত করে পাওয়া যায়। মাথায় হাত রাখল। চোখের কোলে জল জমে এলো। নাকের কাছে প্রাচীন এক কান্না। মা তুমি যাও। আমি ক্লান্ত। তুমি যাও। আমি একটু ঘুমাই।

======

মায়ের জিনিস কিছু নিয়ে নার্সিংহোম থেকে ফিরছে বিশাখা। মা আর কোনোদিন কথা বলবে না। ফোন করবে না। আর কোনো বৈধ বিরক্তি নেই জীবনে। ফোনে আর কোনো মিসডকলের চিহ্নকে নাড়ির উৎপাত বলে মনে হবে না। নাভিটা টাটাচ্ছে। বিশাখা নাভিতে হাত দিল টিশার্টের উপর দিয়ে। ফাঁকা। গভীর। ড্রাইভারকে বলল, আহেরিটোলার দিকে চলো।

আহেরিটোলার গঙ্গার ধার। রেললাইনের পাশ দিয়ে সোজা রাস্তা। চওড়া না। বিশাখা একটা সিগারেট ধরিয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দাঁড়ালো। এত বড় গ্রহটায় তার নিজের বলতে কোনো প্রাণী নেই আর। সব অতীত। একজন সম্পূর্ণ একা মানুষের গা হাত পা চোখ নাক মুখ সব থাকে। একাকীত্ব পোড়ায় না। ভাসায় না। আটকে রাখে। অদৃশ্য বাঁধনে আটকে রাখে। একা মানুষ নিজের কাছে নিজে আটকে যায়। নিজের কাছ থেকে নিজের ছুটি পাওয়া যায় না, যদি না কেউ বাইরে থেকে শিকল খুলে ডাকে। কে ডাকবে? শরীর জ্ঞানবৃদ্ধ এখন। সাড়া দেয় না, ভুরু কুঁচকায়। হৃদয়? আছ? বেঁচে? হাসির রেখা ফুটল। নিজেকে নিজে টিজ মানুষ ছাড়া কে করতে পারে?

সিগারেট শেষ। সন্ধ্যে নেমে আসছে। সামনে শিব মন্দিরে পুরোহিত ঢুকল। সকালের ফুল ফেলে নতুন করে সাজাচ্ছে। আরতি করবে। আরো কয়েকজন জড়ো হল। বিশাখা কয়েক পা এগিয়ে এলো। আস্তিকতায় না, কিছু জড়ো হওয়া মানুষের উষ্ণতা পেতে।

আরতি হল। ঘন্টা শাঁখ বেজে উঠল। কয়েকবার মায়ের মুখটা, শরীরটা ভেসে আসলো। মা পুজো দিচ্ছে। সে খাটে বসে অঙ্ক করছে। হলুদ ডুমের আলোয় মা এক মায়াবী শরীরে ভেসে আছে যেন।

নিন

সামনে দাঁড়িয়ে পুরোহিত। হাতে জ্বলন্ত পঞ্চশিখা। মানুষই একমাত্র আগুন জ্বালাতে শিখেছিল। সে-ই কবে। বিশাখা সঙ্কুচিত হয়ে বলল, আমার অশৌচ… মা চলে গেলেন…

পুরোহিত শুনতে পেলো না। বিশাখা উষ্ণ আশীষ দু হাতে নিল। কেউ যেন বাইরের শিকল ধরে টানল। বাইরে যাওয়ার রাস্তাও ভিতর থেকে, রবীন্দ্রনাথ। ডাকঘর। এ বিরাট সংসারে একাকীত্ব বলে কিছু হয় কি? সব নিয়েই সে। এই মাটিতেই মিশে যাবে একদিন। কোথাও মাথাটা নীচু করতে ইচ্ছা করল। কেউ শিকল ধরে টানছে। যাবে কি? নাকি এই বেশ। নাকি সবটাই ভ্রান্তি?

বিশাখার পা ডুবিয়ে গঙ্গার জলে। কেউ ছুঁয়ে থাকুক তাকে। কেউ একজন। বিশাখা চোখ বন্ধ করে বসে। কেউ ডাকবে না তাকে কোনোদিন, অদরকারে। তবু কেউ একজন ছুঁয়ে থাকুক। কে যেন ছুঁয়ে আছে।

কে তুমি?