Skip to main content
keu bole ni

===

রাত আটটা চল্লিশ। মন্দিরের দরজা বন্ধ করে তন্ময় ঘড়ির দিকে তাকাল। রাস্তার দিকে তাকাল। গেলেই হয়, যেন কোথাও যাওয়ার নেই।

তন্ময় বামুনের ছেলে। বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি। আগে ছিল বেকার। এখন পূজারী। পেট ভরে, কিন্তু মন ভরে না।

স্টেশানে নতুন ফ্লাইওভার হয়েছে। বাড়িতে কেউ অপেক্ষায় নেই। ফ্লাইওভার অপেক্ষায় আছে। তন্ময়, দেখে যা, আয়!

ফ্লাইওভারটা নতুন। অনেক উঁচু। অনেক চওড়া। হালিসহর স্টেশানটার একদিকে পঞ্চায়েত, একদিক মিউনিসিপালিটি। তন্ময় পঞ্চায়েতের দিকে তাকালো। সোজা রাস্তা। দুধারে দোকান। রাস্তায় সাইকেল, রিকশা, টোটো, বাইক, পায়ে হাঁটা, দোকানে দাঁড়ানো কত মানুষ! ফ্ল্যাট, মোবাইলের টাওয়ার, রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া তার, প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করা মানুষ --- সব অন্যরকম। তন্ময় যেন চিল। সংসারের, আবার সংসারের নয়ও।

হঠাৎ কি মনে হল, হাতে ধরা নাইলনের ছোট ব্যাগ থেকে চাবিটা বার করে রেললাইনের ওপর ছুঁড়ে ফেলল। আওয়াজ হল --- ঠুং... অমনি মনে হল, খিলখিল করে হেসে উঠল বিদিশা। কপালে সিঁদুর, হাতে শাঁখা, কার যেন সে বউ। একদিন ছিল তন্ময়ের স্বপ্নসঙ্গিনী। তন্ময় স্বপ্ন বুনত। বিদিশা রঙ করত। একদিন বলল, সব স্বপ্ন নাকি জাল। সব জাল ছিঁড়ে সিঁদুর কপালে বেরিয়ে গেল বিদিশা। স্বপ্নের ঘরে পড়ল চাবি। চাবি হারাল রেললাইনে। নিঃশব্দে।

তন্ময় বিস্ময়ের সঙ্গে শহর দেখছে। নিজেকে দেখছে। বিস্মিত হলে মন চুপ করে যায়। একঘেয়ে হলে বিরক্ত হয়। বিস্ময়ের ঘোর তন্ময়ের মনের কোন অন্ধকার ঘরের খিল খুলল, তন্ময় হনহন করে হেঁটে আপ প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাড়াল। দূরে ট্রেনের আওয়াজ। আপ কল্যাণী লোকাল। পরনের ধুতি সামলে, ভিড় সামলে তন্ময় উঠল ভেন্ডারে।

 

===

কাঁচরাপাড়া শহর গিজগিজে শহর। লোকে বলে মিনি কলকাতা। কিন্তু যাবে কোথায়? ভিড়ের মধ্যে মিশে নিজেকে নিয়ে হাঁটছে তন্ময়। বাবা যেমন ছেলের হাত ধরে হাঁটে। কি খুঁজতে এসেছে? খুঁজতে নয়, ভুলতে এসেছে। তন্ময় এখন একটা অভিযোগহীন মন চায়। অভিযোগগুলো যেন মনের ওপর ঘা। ঘা নিয়ে বেঁচে লাভ নেই। কেউ পাত্তা দেয় না। দুর্গন্ধ ছড়ায়। মনের ওপর ঘায়ের বীজগুড়ি দেখলেই তন্ময় ভীড়ের শুশ্রুষা নেয়। অনেক মানুষের মধ্যে একটা শুশ্রুষা আসে। তন্ময় সন্ধ্যার রুটির দোকানের পাশে এসে বসল।

সন্ধ্যা তন্ময়ের লতায় পাতায় মাসি। বিধবা। একটা গলির মধ্যে বরের রুটির দোকান, নিজের হাতেই চালায়। তন্ময় এসে মাঝে মাঝে বসে। কখনও রুটি কেনে, কখনও মাসির আবদার রাখতে দু-একটা এমনি নিয়ে যায়। সন্ধ্যা কোন প্রশ্ন করে না। খদ্দের সামলায়। সামনের দোকান থেকে চা দিয়ে যেতে বলে তন্ময়কে।

তন্ময় চায়ের ভাড়ে চুমুক দিল। বলল, মাসি চল পুরী যাই।

তন্ময় তার মাসিকে 'তুই' বলে। বয়েস কাছাকাছি বলেই।

সন্ধ্যা বলল, সেই...।

তন্ময় রাস্তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে বলল, কোথাও যাবো না। যা বলল তা বিশ্বাস করল। মাসিকে যা বলল, তা বিশ্বাস করে বলেনি। অভিমান থেকে বলেছে। অভিযোগ যদি হয় ঘা, অভিমান মানে ফোস্কা। টসটস করে কখন ফেটে যায়, বোঝা যায় না। ফোস্কা ফেটে ঘা-ও হয় কখনও কখনও অস্বাস্থ্যের প্রশ্রয় পেলে।

তন্ময় হঠাৎ উঠে দাড়ালো। মাসিকে কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করল গঙ্গার দিকে। অনেকটা রাস্তা। কিন্তু তাকে তো যেতেই হবে। একতাল গঙ্গামাটি লাগবে কাল পুজোর জন্য। না হলেও চলে, তবু আনবে নাই বা কেন? কিন্তু চাবি! ভয় হল। রাগ হল নিজের ওপর। নিজেকে মাঝে মাঝে চিনতে পারে না তন্ময়। নাকি আরেক তন্ময় গলার কাছে উঠে আসে, বদ ঢেকুরের মত? যা হোক, ডুপ্লিকেট চাবি বিদ্যুৎদার কাছে পাওয়াই যাবে। সে তো মন্দিরের হোতা। শালা মালখোর একটা।

এখন দরকার গঙ্গামাটি। তন্ময় হাঁটছে ভিড় ঠেলে। ভিড় ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে ফাঁকা একটা গঙ্গাতীর ডাকছে, আয়, তন্ময় আয়। হাত চাইছে জলে ডুবে গঙ্গামাটি। তল চাইছে।

 

===

ফাঁকা গঙ্গার তীর। তন্ময় নামলো নদীর তীরে।

বিদিশা বলল, ডুবে মরলেও ক্ষতি নেই। মরা বাপ-মা আকাশের তারা হয়ে বলল, চলে আয়। তন্ময় দু'জনকেই বলল, এখন না।

গঙ্গামাটি নিল। ব্যাগের মধ্যে রাখা খবরের কাগজে জড়াল। কাগজ ভিজল। মনের ভিতর সুখের মত। ব্যাগের মধ্যে রেখে আবার হাঁটতে শুরু করল।

হাঁটতে হাঁটতে মন বলল, চাবিটা ছুঁড়েছিলি কেন? তন্ময় বলল, ফিরতে চাই কিনা দেখার জন্য। মন বলল, আমার হারাবার ভয়। তন্ময় বলল, আমার ভয় ডোবার।

হালিসহর স্টেশান পর্যন্ত রেললাইন ধরে হাটল। উৎকন্ঠা বাড়ল। তবু জানে সে চাবিটা পাবেই। কেউ যেন এ সংসারে চায় সে থাকুক। সে কে? জানে না।

চাবিটা পেলো। হারিয়ে যাওয়া সন্তানের মতো। তন্ময় মন্দিরে ঢুকল। আলো জ্বালল। মাটির তালটা মায়ের মুর্তির সামনে রেখে বলল, ভয় পাস না। আমি কোথাও যাবো না। আমি আছি।

এই কথাটাই সে মৃত মায়ের মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিল। বিদিশার কাছ থেকে শুনতে চেয়েছিল। ঈশ্বরের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছিল।

কেউ বলেনি।

 

(ছবি - Suman)