Skip to main content

কেন লিখছি? প্রতিক্রিয়ায় না চিন্তায়? কোনটার রূপ দিতে? 
     ক'দিন ধরে আমাদের রাজ্যে বেশ চাপান-উতোর চলছে। তার সাথে চলছে ফেসবুকীয় বিষোদগার। কি লাভ হচ্ছে সে প্রশ্নে যাব না? যেটা বলার ইচ্ছা সেটা হল, এ সবের গভীরতা কতদূর? মানে হাঁটু অবধিও তো ডোবে না দেখছি। রাজনৈতিক যে কোনো দল কিছু মানুষের দ্বারা গঠিত। যে মানুষেরা বেশিরভাগই এই বাংলার। তাদের আজ বাম, কাল ঘাসফুল, পরশু পদ্মফুল হতে হচ্ছে, কারণ সেটার সাথে স্বার্থ জড়িয়ে। আদর্শ কথাটা এখন অভিধানের নিজস্ব শুধু। অন্তত বাংলার মাটিতে। আর সেটা রাজনীতি কেন? কোনো নীতিতেই বর্তমান নেই। যিনি ত্রিশূলের মাথায় কণ্ডোম পরিয়ে উদারতার দোহাইয়ে নিজের অবস্থান সমর্থন করছিলেন, তিনিই একজন মন্তব্যকারীর শ্লেষ সহ্য করতে না পেরে comred ভুল বানানের দোহাইয়ে ব্লক করার হুমকি দিচ্ছেন দেখলাম। করতেই পারেন। কারণ ওই যে বললাম, নীতি একটাই - স্বার্থনীতি। 
     যে কোনো কাজের দুটো দিক থাকে। উদ্দেশ্য আর উপায়। উপায় যতই মহৎ হোক না কেন, উদ্দেশ্য যদি ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে তবে সেটা বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে, বিশেষ করে দুর্বল মস্তিষ্কে। একজন সাধক দক্ষিণেশ্বরে এক মহিলার সাথে ফষ্টিনষ্টি করছিল। যা রামকৃষ্ণের দৃষ্টিতে পড়ে। তিনি তাকে ভর্ৎসনা করতে গেলে সেই সাধক বলে, “কেন ঠাকুর, তুমি বেদান্ত পড়োনি, সবই তো স্বপ্নবৎ, মিথ্যা, মায়া। আর সব যদি মিথ্যাই হল তবে আমার এই কাজটাই কি খালি সত্য হয়ে টিকে থাকবে?” রামকৃষ্ণ এই সব ক্ষেত্রে অত যুক্তি তর্কের ধার ধরতেন না, কারণ যার নিজের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই সাথে অহং এর দাসত্বও নেই সে কেন খামোখা এই ভ্রান্ত তর্কে যেতে যাবে। তিনি বলেন, তোর ওই ব্রহ্মজ্ঞানে শালা মুতে দিই। 
     এই হল কথা। এখন এত যে চীৎকার, এত যে হইহট্টগোল, সে তো দেশের মঙ্গলের জন্য নয়, সে তো আত্মজাহির বা প্রতিষ্ঠা যাই বলি না কেন তার জন্য। কারণ সত্যি বলতে বাংলার কাজের জন্য নবান্ন অভিযান, বিক্ষোভ প্রদর্শন ইত্যাদি কাজ ছাড়া অনেক আশু প্রয়োজনীয় প্রভূত কাজ বাকি। অবশ্যই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ, তবু তুচ্ছ নয়। 
     কথাটা হল তৈরি করা অস্থিরতা আর তার শিকার হয়ে পড়া নিয়ে। আর তার সাথে সেই ডামাডোলের বাজারে আরেকটু ঘি ছড়িয়ে আগুনটাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে। কি লাভ হচ্ছে এতে? কোলাহল, উন্মত্ততা, অস্থিরতার রাস্তায় যারা দেশোদ্ধার করতে নেমেছে তারা ইতিহাসের পাতায় ভবিষ্যতের গৌরবহীন অধ্যায়। ওতে আমার আপনার কিচ্ছু আসে যায় না, এক যদি না সেই রণক্ষেত্রে সশরীরে গিয়ে উপস্থিত হয়ে পড়ি। একটা কথা তো স্পষ্ট, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, প্রয়োজনটা যখন কম হয়, তখন আয়োজনটা বেশি হয়ে পড়ে। গভীরের তাগিদটার যেখানে অভাব, সেখানে বাইরের ভাণটাই একমাত্র সম্বল। মানুষেরা আস্থা জন্মায় কি উত্তেজনায়? না তো, সে জন্মায় ধীর, স্থির, ঐকান্তিক নিরবচ্ছিন্ন সংযত প্রচেষ্টায়। সাধারণ মানুষ চিরকালই নিরাপত্তা আর শান্তির পক্ষে থাকবে। তাকে বিঘ্নিত করতে চাইলে সে তখনই তাতে সামিল হবে যদি তাকে আরো গভীর কোনো প্রলোভন দেখানো যায় স্বচ্ছতার, শান্তির আর নিরাপত্তার। ধরে নিই যদি সে প্রলোভনের টোপটাও কার্যকারী হয়ে গেল, তবে কি হবে? তাই হবে যা হচ্ছে আজ দিল্লী আর বাংলাতে। 
      আমি বিকল্প খুঁজতে পারি দুটো কারণে। হয় আমার বর্তমান পরিবেশ অসহ্য হয়ে উঠছে, অথবা বিকল্প সত্তাটার উপর আমার গভীর আস্থা। পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনটার পিছনে ছিল প্রথম কারণটা গুরুতর, মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছিল। আর কেন্দ্রের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ছিল দ্বিতীয় কারণটা, মানুষ একটা নতুন স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিল। আজ আমেরিকাতে যে ফলটা হয়েছিল তাও ওই অসহনীয় একটা মানসিকতা থেকে - দেশকে উগ্রপন্থী আক্রমণের মূল উপড়াবার স্বপ্নে বিশ্বাস করে। 
      কি হল, না হল, তা ইতিহাসের হাতে থাক। কিন্তু আমাদের এই অস্থির সময়টাতে আরো তীব্র প্রতিক্রিয়া শুধু জলই ঘোলা করবে। আমাদের মধ্যে দুটো সত্তা থাকে। এক ব্যক্তিসত্তা আর দুই সমষ্টিসত্তা। এই দুটোর পার্থক্য যে সভ্যতায় যত বেশি সেই সভ্যতার পরিকাঠামো ততটাই দুর্বল। ভারতের সমাজের একটা বড় দুর্বলতা ছিল সে ধর্মে-দর্শনে যতটা উদারতার ছাড় দিয়েছিল, সমাজে দেয়নি। সেখানে শিকলের পর শিকল। তাই ব্যক্তিসত্তা আর সামাজিক সত্তা চূড়ান্ত পৃথক হতে বাধ্য হয়েছিল। একটা আমার পারমার্থিক দিক, আরেকটা আমার জাগতিক দিক। ফলে আধ্যাত্মিকতায় যতটা ওঠা গেল নীতিতে ততটা ওঠে গেল না। হত্যা, অত্যাচার, জাতপাতের পৃথকীকরণ, শোষণ পীড়ন ততটা পাপের নয়, যতটা অমুক নক্ষত্রে বা তিথিতে অমুক খাদ্যভক্ষণে। পরম পূণ্যও সেই একই খাতে বইল, অমুক দেবতার নাম এত লক্ষবার, কিম্বা অমুক তিথিতে অমুক নদীতে ডুব ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, আমাদের কৃত্রিম পাপের যেমন সীমা-পরিসীমা নাই, সেরকম আমাদের কৃত্রিম প্রায়শ্চিত্তেরও নেই। তবে এতো উত্তেজক মানুষ আসে কোথা থেকে? মানুষের ব্যক্তিসত্তাটা যখন দুর্বল থাকে তখন সে তার মধ্যে সমষ্টিসত্তাটাকে অনুভব করতে পারে না। সে সাড়া দেয় সংখ্যা গরিষ্ঠের দিকে। একে সে চিরকাল নিরাপদ জেনে এসেছে। মনে রাখতে হবে যে মহতের পায়ে না কিন্তু, সে আত্মসমর্পণ করছে বৃহৎ সংখ্যার পায়ে। কোপার্নিকাস, গ্যালীলিয়, মেণ্ডেল তথা বিজ্ঞানী থেকে খ্রীষ্ট, রামকৃষ্ণের জীবদ্দশাতেও লোকে এদের ভ্রান্ত জেনেছে। অতদূর কেন, না হলে সতীদাহের মত প্রথা ভাঙতেও রামমোহনকে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ নিতে হয়? 
      নিজের ব্যক্তিসত্তাকে ওই সমষ্টিসত্তার পায়ে যতক্ষণ না বিসর্জন দিতে পারছি, ততক্ষণ কোনো সত্যবাক্য, মঙ্গলজনক কথা সত্য অর্থে আমার চিত্তে উদ্ভাসিত হবে না। আমি বাইরের সেই খণ্ডিত সত্তায় প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি করে কিম্বা প্রবলভাবে সাড়া দিয়েও অনায়াসে নিজের ব্যক্তিসত্তায় ফিরে এসে পর্দা টেনে ঘুম লাগাতে পারি। এ ভাবে আর যাই হোক, বিপ্লব হয় না। বিপ্লব আমুল পরিবর্তনের কথা বলে। কেবল বাড়ির বাইরের রং পাল্টে জগতের চোখে ধুলো দিয়ে নয়। ভিত নাড়াতে হবে। সে সাধনা কই? সে ত্যাগ কই? সে অধ্যবসায় কই? 
      এ যে 'এসেছো কি হেথা যশেরও কাঙালি/ কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি'..