কাজটা শুরু করতে দেরিই হল। জ্বর ছিল দুদিন।
সকালটা সুন্দর। রোদ এসে পড়েছে পার্কের সবটা জুড়ে। গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে। গাছগুলো রোদের আলোয় উজ্জ্বল। তার মনের মত। তার মনের মধ্যে রোদের মত আনন্দ সহজভাবে জন্মায়। থাকে। মাঝে মাঝে মেঘ করে। বৃষ্টি হয়। গুমোট হয়। আবার রোদ হয়।
সামনে কালো কালো তিনটে মূর্তি। রবীন্দ্রনাথ। বিদ্যাসাগর। বিবেকানন্দ। মূর্তিগুলো পরিষ্কার করতে হবে। আটশো টাকা দেবে ক্লাব থেকে।
মই নিয়ে উঠল উপরে। বেদীতে। উপর থেকে নীচটা দেখলে মাথাটা অল্প টাল খায়। জ্বরটার পর একটু বেশি দুর্বল করেছে। টাল ভালোই লাগছে।
নীল কাপড়টা প্যাণ্টের পকেট থেকে বার করে রবীন্দ্রনাথের মাথাটা মুছতে শুরু করল। দাড়ির মধ্যে মধ্যে ধুলো জমে আছে। নাকের পাশে একটা সাদা দাগ, কাক বা পায়রার পায়খানা হবে। অল্প চাপ দিতেই উঠে গেল। এক মগ জল লাগবে।
মই বেয়ে নীচে নামল। মগ তো নেই। ক্লাবের ঘর বন্ধ। একটা আধভাঙা রঙের বালতি পড়ে। উলটে আছে। সেটাকে সোজা করে দেখল, এতে কাজ চলে যাবে।
পার্কের যেদিকে প্যাণ্ডেল, তার পিছন দিকে একটা চাপা কল আছে। সেখানে গিয়ে আধ বালতি জল ভরল। জলটা নিয়ে প্যাণ্ডেল পেরিয়ে যখন পার্কের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে, দেখল বালতির জলে রোদের ছবি পড়ে কেমন ঢেউ খেলছে। বালতিটা দুলছে। জল দুলছে। সূর্য দুলছে।
তার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ল। পুরীর সমুদ্রের কথা। বাবার সঙ্গে যেত। ঠিক এইরকম রোদের ছবি জ্বলজ্বল করে দুলে থাকত ঢেউয়ে। মনের মধ্যে আগের দিনের ছবি মোমবাতির মত জ্বলে। মোম গলে গলে পড়ে। জ্বালা করে। ব্যথা হয়। তবু ভালো লাগে। চারদিক অন্ধকার, মধ্যে স্মৃতির মোমবাতির আলো। ভালো লাগে।
========
বিদ্যাসাগরের ধুতির ভাঁজে ভাঁজে আর বিবেকানন্দের পাগড়ির ভাঁজে, খাঁজে ধুলো জমেছে শক্ত হয়ে আছে। পাগড়িতে, চাদরে পাখির গু। সময় লাগবে। জল লাগবে আরো। কেউ এলে হত। জলটা এগিয়ে দিত। কিন্তু কে আসবে? সংসারে তার কেউ নেই। বন্ধু আগে দু একজন ছিল। এখন নেই তেমন কেউ। ওরা বাইরে চলে গেছে। কেউ পুণে, কেউ কেরালা, কেউ ব্যাঙ্গালোরে। তাকেও ডেকেছিল। সে যায়নি। কেন যায়নি জানে না। যায়নি এটাই সত্যি।
ঘন্টা দুই লাগল মূর্তিগুলো পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু এই বেদীটা ছেড়ে নামতে ইচ্ছা করছে না। কাপড়টা ধুয়ে এনে আবার করে মূর্তিগুলো ডলছে। তার কাপড়ের সঙ্গে মূর্তিগুলো যেন কথা বলছে। কী কথা বুঝতে পারছে না। কিন্তু একটা কথোপকথন তো হচ্ছেই।
=======
সে সিক্সের পরে আর পড়েনি। বাবা মারা যাওয়ার পর আর পড়তে ভালো লাগল না। মা-ও কদিন পর চলে গেল। ব্যস। গোটা মালাটাই যেন ছিঁড়ে পুঁথিগুলো এর পায়ে ওর পায়ে ধাক্কা লেগে হারিয়ে গেল। প্রথম কয়েকদিন খুব চেষ্টা করেছিল। তারপর একদিন নিজেকে বলল, যথেষ্ট! আর না!
সে যখন কলেজ স্ট্রিট দিয়ে হেঁটেছে, বড় বড় লাইব্রেরিতে কোনো ঠিকের কাজে গেছে, নিঃশব্দ বইয়ের শবের ভেতর দিয়ে হেঁটেছে তার মনটা উদাসীন হয়েছে। কী হত সে যদি জানত এই বইগুলোতে কী লেখা আছে? সে তো কত পড়াশোনা জানা মানুষ দেখেছে। ভালো না তারা। মানুষকে কষ্ট দেয়, ব্যবহার করে ডাস্টবিনের মত। মর্যাদা দেয় না। অথচ কী দামী গাড়ি, বাড়ি। অনেক নামডাক তার। দেখেছে তো। বইয়ের উপর কোনো মোহ নেই তার। বেশ কিছু বই পড়ে দেখেছে। এক সময়ে মনে হয়েছে এতে তার আনন্দ না বেড়েছে, না কমেছে। বরং মনের মধ্যে ভার বেড়েছে। অনেক সময় এমন অনেক কথা মনে হয়েছে যা তার নিজের কথা না, কোনো বইয়ের পড়া কথা। বিরক্ত লেগেছে। কেন আসবে? যদি বইয়ের ধার করা কথাই আসবে, তবে আর নিজেকে জানবে কী করে? সেই সময়ে তার নিজের কী ভাবনা আসত, সে তো জানতেই পারল না। একটা অন্যের ধার করা ভাবনার ভার বয়ে লাভ কী?
=========
এখন সে আনন্দকে স্রোতের মত বয়ে যেতে দেয়। তাকে আটকিয়ে এর ওর ভাবনার ঘূর্ণি তৈরি করে না। সে ঘূর্ণিতে পিষে মরার চাইতে এ অনেক ভালো। স্রোতের ব্যাখ্যা চায় না। গন্তব্য জিগায় না। জলের নাব্যতা পরিমাপ করে না। সে দেখে একটা শান্ত স্রোত অহর্নিশি তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে, বয়েই চলেছে। সুখ দুঃখ কিছুই তাকে আটকায় না।
পার্কে এলো একজন। চেনে সে। সাধারণ সদস্য। মূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, কাল বৃষ্টিতেই তো অর্ধেক কাজ সেরে রেখেছে তোর…..তাই না?
সে হাসল। লোকটা চাইছে সে ‘হ্যাঁ’ বলুক। মানুষ নিজের গোঁফের থেকেও বেশি যত্নে রাখে নিজের মতামত। একটু এদিক ওদিক হলেই টান লাগে, ক্ষেপে যায়। ভাবে তার গোঁফ উপড়াবার মত করে কেউ হয় তো তার মতামত উপড়াতে চাইছে। মত উপড়ে গেলে কী থাকে আর?
এরা যারা প্রচুর জানে তারা বোঝে না মতামতের মানুষটার চাইতে অনেক বেশি দামী সেই আসল মানুষটা যার কোনো মত নেই, কিন্তু চেতনা আছে। আনন্দ আছে। আর যা কিছু মিথ্যা তার সঙ্গে একটা ছুকিতকিত খেলা আছে।
সে বলল, তা যা বলেছেন। অনেকটাই কাজ কমে গিয়েছিল।
সে প্রসন্ন হেসে বলল, জানি তো। তবে আর আটশো নিস না। পাঁচশোই নে। এমনিতেই এবারে বাজেট ফেল করছে।
সে জানে, পড়াশোনা তেমন না জানলেও জানে যে এই তিনশো টাকায় এতবড় পুজোয় কিছু পার্থক্য হত না। কিন্তু জেদ। মতামতের জেদ। থাক। সে মনে মনে বলল, মা তোকেই দিলাম আমার হকের তিনশো টাকাটা। তোর অবস্থা তো আমার থেকেও খারাপ দেখছি। এদের মদের খরচ যোগাতেই তো মা অর্ধেক বাজেট ফেল করে যায়।
যা হোক, মুখে সে বলল, যা আপনি ভালো বোঝেন….আমি আর কী বলব?
=======
ছশো টাকা নিয়ে সে পার্ক থেকে বেরোলো। একশো টাকাটা বকশিস। কাজ ভালো করেছে বলে না। বচসা করেনি বলে। তার জেদকে তোয়াজে রেখেছে বলে। যদিও মুখে বলল, সে কাজে খুশি হয়ে দিল।
বালতিটা কী করব?
ওটা? ধুস! ওটাকে বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে চলে যা। আর শোন অষ্টমীর দিন এসে ভোগ খেয়ে যাস।
সে আসবে না। ভিড় ভালো লাগে না। এত সাজ, এত হুল্লোড় ভালো লাগে না। হুল্লোড়ে এলে আনন্দ কমে যায়। আনন্দ কমে গেলে আবার হুল্লোড় খুঁজতে হয়। নয় নেশা। মদের নেশা, পাণ্ডিত্যের নেশা, প্রতিভার নেশা। আরো অনেক অনেক নেশা আছে মানুষের। আনন্দকে ক্ষয় করে দেয়।
বালতিটা ডাস্টবিনে ফেলল না। এতে একটা গাছ লাগাবে। পুজোয় নতুন কিছু কেনেনি এবার। একটা গাছ কিনবে। ভাঙা বালতিতে লাগাবে। যেদিন ফুল হবে সেদিন সে সুখী হবে, আর ভাঙা বালতিটা পাবে সান্ত্বনা। এইটুকুই তো একজন মানুষ আরেকজনকে দিতে পারে। কেন দেয় না কে জানে…..